শামীম রুনা: কিছুদিন আগে উইমেন চ্যাপ্টারে জেসমিন চৌধুরীর লেখায় দেখলাম, সে মেয়েবেলার ইচ্ছা পূরণে নামছে। যদিও সে গাড়ি চালাতে পারে, কিন্তু সাইকেল চালাতে পারে না, তাই নতুন করে সাইকেল চালানো শিখতেছে।
কৈশোরে দেখছে, বাবা শখ কইরা বড়ো ভাই এর জন্য সাইকেল কিনে আনছে, কিন্তু বাবা’র একই বয়সী আরেক সন্তান হইয়াও তারে সাইকেল চালানো থেকে বঞ্চিত থাকতে হইছে। কারণ সে মেয়ে! আহারে! এই মেয়ে মেয়ে বইলা, মেয়েবেলায় আমাদের কত কিছু থেকে না বঞ্চিত করছে আমাদের অভিভাবকরা। আর ধীরে ধীরে সময়ের বিবর্তনে-এ হারায়া গেছে আমাদের সদ্য সদ্য রাঙা হয়ে ওঠা কৈশোর। মাত্র পাখনা মেলা কৈশোর।
কিশোরী বেলায় আমরা গ্রিলঘেরা বারান্দায় দাঁড়ায়া শকুনীর মতো হিংসার চোখে তাকাই দেখছি, আমাদের বয়সী কিশোররা তাদের ছেলেবেলায় বিকাল হলেই ফুটবল মাঠ দাবড়ায়া খেলতেছে। যে পোলা এক সময় আমার কাছে ব্যাডমিন্টনে পাত্তা পাইতো না, পরের বছর শীতের বিকালে দেখছি সে পোলা র্যাকেট নিয়া খেলতে যাইতেছে, আর আমি নম্র-ভদ্র বালিকার রূপ ধারণ কইরা বারান্দায় কোনো গল্পের বই’র পাতায় দীর্ঘশ্বাস মিশাইছি। এই তো আমাদের মেয়েবেলা!
তারপরও মাঝে মাঝে সুযোগ পাইলেই কৈশোরের আনন্দে মাততে চাইতাম। স্কুল লাইফে থাকতাম বড়ো আপা আর দুলাভাই’র সঙ্গে মৌলভীবাজার, ভোলা, বরিশালের মতো শহরের কলোনিতে। দুলাভাই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। যখনই আপা আর দুলাভাই কলোনির বাইরে কোথাও বেড়াইতে যাইত, অফিসের পিওনের সাইকেল নিয়া পুরা কলোনি চক্কর দিতাম।
বিশাল আর নড়বড়ে একখান সাইকেল, তারপর ছিল না ব্রেক; কিন্তু চালানোর আনন্দে ওই সাইকেলই টানা এক দেড় ঘন্টা চালাইতাম। আমার ধারণা ছিল, যেহেতু আপা-দুলাভাই কলোনিতে নাই, তাই জানতেছেও না আমার এই সব কীর্তিকলাপ।
একদিন ব্রেকলেস সাইকেল নিয়া সোজাসুজি গিয়া ধাক্কা খাইলাম দুলাভাই এর বসের কারের বনেটে, গাড়ির ড্রাইভার সময়মতো ব্রেক করাতে হাত-পা রাস্তার পিচে ঘষা খাওয়া ছাড়া আর বড়ো কোনো ব্যাথা পাই নাই, কিন্তু সবচেয়ে বড়ো ব্যাথা পাইছিলাম আমার সাইকেল চালানো এরপর বন্ধ হয়ে গেছিল।
সেটা ছিল এসএসসি পরীক্ষার আগের আগের ঘটনা। তারপর নিজের কন্যাদ্বয়ের জন্য সাইকেল কিনছি, ঢাকার ব্যস্ত গলির রাস্তায় ওদের মাপা দূরত্বে সাইকেল চালাতে দিছি, কিন্তু কখনো নিজে চালানোর চেষ্টা করি নাই।
ঢাকার রাস্তায় মেয়েরা স্কুটি চালাইতেছে, হাভাইতার মতো দেখছি; নিজে যদি এমন স্বাধীনভাবে কোনো স্কুটি চালাইতে পারতাম! নিজেরে ভীরু আর পুরান জামানার বইলা ভ্রম হইতো, মনে হইতো এখন স্কুটি চালাইলে আমারে মানাইবো না। লোকে হাসবে, ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ দেয়াল সব সময় সামনে খাড়ায়া ছিল।
এখন এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে ভাষা শেখার পাশাপাশি একস্ট্রা কিছু করারও অপশন থাকছে। ওদের সাইকেল কোর্সের অপশন দেখে পুরনো ইচ্ছাটা আবার মাথা চাড়া দিয়া উঠলো। এই দেশে তো সত্তর আশি বছরের বুড়িদেরও দেখি সাইকেলের সিটে টান টান বইসা গটগটায়া সাইকেল চালাইতেছে। সে হিসাবে তো আমি এখনো ‘ইস্কুলে পড়ুয়া বালিকা’। সাইকেল কোর্সে প্রথম দিনে সিটে বসে বুঝলাম, আরে বাহ্! লুকিয়ে-চুরিয়ে শেখা বিদ্যাটা ভুলি নাই!
ইয়েস ফাইনালি সাইকেল চালানোর জন্য আমি মেডেল এবং একটি সার্টিফিকেট অর্জন করেছি। ক্রমাগত হারানোর সময়টাতে এই অর্জন আমাকে এক বিন্দু হলেও আনন্দ দিতে পারছে-খারাপ না, কী বলো?