শামীম রুনা: আগে বাঁচার শর্ত ছিল, অন্ন, বস্ত্র বাসস্থান। আর বর্তমানে বাংলাদেশে বাঁচার শর্ত হলো বাঁচতে দাও। যারা দেশে বাস করছেন তাঁরা ভাবেন, যদি কোনরকমভাবে বেঁচে যেতে পারি…। রাষ্ট্র আমাদের বাঁচার গ্যারান্টি দেয় না। সরকার আমাদের বাঁচার অধিকার দিতে চায় না।
পুলিশ প্রশাসনও নিরাপত্তা দিতে অস্বীকার করে। তাহলে, সাধারণ জনগণ কোথায় যাবে? নিজের দেশেই যদি স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নিয়ে বেঁচে বর্তে জীবনযাপন করতে না পারে, তবে আমার দেশ মধ্যম আয়ের দেশ হলেই কী, আর উচ্চ বা নিম্ন আয়ের দেশ হলেই কী!
ফেসবুকে আবার যা দেখলাম, তা আমরা আর দেখতে চাচ্ছি না বহুদিন ধরে। তারপরও এসব আমাদের আরও দেখে যেতে হবে। বার বার দেখতে হবে। আমাদের যেন এই দেখে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই, মুখ খুললে আমাদের হত্যা করা হচ্ছে, তাই আমরা দেখছি আর অন্ধ হচ্ছি, শুনছি আর বধির হচ্ছি, জানছি আর জ্ঞানপাপী হচ্ছি।
আবারও দুইজন খুন হলেন। একজন পুলিশের এসপি’র স্ত্রী। ভদ্রমহিলা সম্ভবত অন্য কোনো পেশায় ছিলেন না, সাধারণ গৃহিনী ছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা ভদ্রমহিলা নাস্তিক ব্লগার ছিলেন না। ছবি দেখে মনে হলো তিনি হিজাবীও ছিলেন। তারপরও তাঁকে নির্মমভাবে খুন হতে হলো। তাঁর অপরাধ কী ছিলো? তাঁর দোষ তিনি একজন ডেসপারেট আর সৎ পুলিশ অফিসারের স্ত্রী ছিলেন। জঙ্গী দমনসহ বেশ কিছু সাহসী অভিযানের জন্য তাঁর স্বামী বাবুল আকতার সততার পরিচয় দিয়েছেন এবং সম্মান অর্জন করেছেন।
জিওসি’র মোড়ের মতো একটি জনবহুল জায়গায় তাঁকে ছুরিকাঘাত করে তারপর গুলি করে খুনিরা মৃত্যু নিশ্চিত করে সবার চোখের সামনে দিয়ে খুব সহজে পালিয়ে গেছে এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে। সাহসী স্বামীর পুলিশি পোশাক বা ধর্মের পোশাক কোনোটাই তাঁকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি।
এইসব খুনিদের কাছ থেকে এখন আমরা ঘরে-বাইরে-রাস্তায় কোথাও নিরাপদ নেই। আর এই যত্রতত্র খুন করার লাইসেন্স সরকারই ওদের দিয়েছে একটি খুনেরও বিচার না করে। কয়েক দিন আগে এক সর্বোচ্চ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা বলেছে, সকল নাগরিকের নিরাপত্তার দায়িত্ব তারা দিতে পারবে না, তারপর তাদেরই সহকর্মীর স্ত্রী প্রকাশ্যে খুন হওয়াতে এটাই কী বোঝায় না পুলিশ আর কোনো রকম নিরাপত্তা দিতে অপারগ? শুধুমাত্র মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হওয়া ছাড়া।
দীপুমণির খালাতো ভাই, আমেরিকান এ্যাম্বেসিতে ভালো জব করা জুলহাজ মান্নান খুন হলে আমাদের মনে ক্ষীণ আশা জন্মেছিল, এবার বিচার হলেও হতে পারে।
ড. অভিজিৎ রায় খুন হলেও আমরা ভেবেছিলাম রাজীব হত্যার বিচার না হলেও মার্কিন পাসপোর্টধারী অভিজিৎ রায় হত্যার হয়তো বিচার হবে। তখন আমরা দেখেছিলাম, খোদ আমেরিকা থেকে এফবিআই’র গোয়েন্দাদের ছুটে আসতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেসব কিছু প্রহসন ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
সত্যি কথা হলো, আমাদের সরকার পুরোটাই মৌলবাদী জঙ্গিদের হাতে জিম্মি হয়ে দেশ শাসন করছে। তাই জনগণের সুরক্ষার চেয়ে সরকারের কাছে জঙ্গি সুরক্ষা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই জঙ্গি দমনে সক্রিয় বাবুল আকতারের স্ত্রী হত্যার বিচার হবে বা খুনি ধরা পড়বে এমনটি আমরা আশা করতে পারি না। কেননা, এতে করে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
একটি খুনের সংবাদ আমাদের কাছে সহনীয় হয়ে ওঠার আগেই আর একটি খুনের ঘটনাও আমাদের আর তেমন করে আলোড়িত করতে পারে না এখন আর। এখন দুই-একটি খুন-হত্যা-গুম আমরা অনায়াসে উপেক্ষা করে টিস্যু পেপার দিয়ে হাত মুছে ভাত খেতে খেতে টিভিতে টক শো দেখার মতো সুশীল সমাজের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি।
তারপরও, কোথায় যেন কুটকুট করে কিছু প্রশ্ন, নাটোরের অজপাড়া গাঁয়ের খ্রিস্টান মুদি দোকানদারের এমন কী অপরাধ ছিল, যাতে ইন্টারন্যাশনাল জঙ্গি গোষ্ঠিকে তাঁকে খুন করার জন্য মাথা ঘামাতে হয়েছে!
আগের হত্যাগুলো ছিল বড় শহরকেন্দ্রিক এবং লেখক, শিক্ষক বা শিক্ষিত জনগোষ্ঠি বলতে আমরা যাদের বুঝি সাধারণত তাঁরা টার্গেট ছিলেন। একটি খুনের পর বর্তমানের তুলনায় দীর্ঘ বিরতি দিয়ে পরবর্তী হত্যাযজ্ঞ ঘটাতো খুনিরা। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি এমন হয়েছে, এই হত্যাযজ্ঞ বড় শহরগুলো ছাড়িয়ে গ্রাম-গঞ্জ এমন কী পাহাড়ের গভীরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
এখন কয়েকদিনের ব্যবধানে এবং খুব সাধারণ মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে দিনে একাধিক হত্যাকাণ্ডও ঘটানো হচ্ছে। কেন? এরা কি নিজেদের শক্তির পরিচয় দিচ্ছে আমাদের? জানিয়ে দিচ্ছে, হোমিও চিকিৎসক থেকে গ্রামের নিরীহ মুদি দোকানদারসহ আমরা কেউ আর নিরাপদ নই?

আজকের এই দুই মৃত্যুও হয়তো দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আর তাই আমরা জানি, বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিচার হয় না। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা দায়িত্বশীল অন্যান্য মন্ত্রীরা কোন আইনের অধীনে জনগণকে জানায় যে, বিচ্ছিন্ন কোনো হত্যা বা ঘটনার বিচার হতে পারবে না! প্রথম থেকে যদি একটি করে বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিচার হতো, তাহলে আমাদের হয়তো এত বিশাল বিচ্ছিন্ন ঘটনার মুখোমুখি হতে হতো না।
আমাদের গনতান্ত্রিক সরকারের দেশের নাগরিকদের প্রতি কোনো রকম দায়বদ্ধতা নেই তাও মানা যায় না। সরকার বার বার আমাদের বিচ্ছিন্ন ঘটনার গল্প শোনাবে, কখনও বা ছয়জনের ঝাপসা ছবি আমাদের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বলবে, ‘পারলে ধরো’ এ কেমন নীতি সরকারের! সরকারের এতো এতো বাহিনী কি শুধুই প্যারেড আর বডি পাহারার জন্য! এইসব বাহিনী কী পারেনা ছবির লোকদের ধরতে; সাধারণ মানুষকে লাগে! নাকি এটাও কুমিরের ছানা দেখানোর মতো কোনো গল্প? কোনো দেশের সরকারের অবস্থা যতই নড়বড়ে হোক না কেন তারও একটি কাঠামো থাকে। আমাদের নির্বাচিত সরকারেরও একটি শক্ত কাঠামো আছে, এবং সরকারের অজানায় একের পর এক হত্যা চলছে এ যেন কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
তাই বলি, বন্ধ করুন এইসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার নাটক। তা না হলে এই বিচ্ছিন্ন ঘটনার মূল্য আমাদের আরও অসংখ্য তাজা প্রাণ দিয়ে দিতে হবে, সে হিসাব সুরক্ষাবেষ্টিত সরকারের প্রতিনিধিরা বুঝতে পারছে না; আধমরা সাধারণ মানুষ ঠিকই বুঝতে পারছে।