রিয়াজুল হক: উড়ানযাত্রা আমার পছন্দ নয়। নৌযাত্রা আমার সবচেয়ে প্রিয়। তারপর সড়কযাত্রা। উড়ানপথে নয়, সড়কপথেই আজ ঢাকা থেকে দিনাজপুর এলাম। পথে তিনটি স্থানে বিরতি নিলাম। বিকেলে তৃতীয় বিরতি নিলাম দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার মতিহারাপুর বাজারে।
ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। দোকানদারের নাম বাবুল আক্তার। বয়স আনুমানিক ৫৫। ইস্পাহানি টি ব্যাগ দিয়ে বানানো গরম চা। সাথে লেবু, আদা ও লবঙ্গ। মূল্য প্রতি কাপ মাত্র ৪ টাকা। দু’কাপ চায়ের মূল্য (আমার ও গাড়িচালকের) ১০ টাকা দিতে চাইলে হাসি দিয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন।
ক’ ছেলে-মেয়ে? প্রশ্ন করতেই তার জীবনের গল্পটা এক নি:শ্বাসে বলে দিলেন। বড় ছেলে সেনাবাহিনীতে। মেঝ ছেলে বস্ত্রকলে। ছোট ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে মেট্রিক (তাঁর ভাষায়) পাশ করার পর। কিন্তু শর্ত ছিল মেয়েকে পড়াতে হবে। বিয়ের পর মেয়ের পড়ার খরচের অর্ধেক তিনি বহন করবেন, বাকিটা দেবেন মেয়ের জামাই। সেভাবেই বড় মেয়েটির পড়ার খরচ নির্বাহ করা হয়েছে। এবারে বড় মেয়েটি ডিগ্রি (তাঁর ভাষায়) পরীক্ষা দিয়েছে।
পাশ করার পর বড়মেয়ে কী করবে? কেন! চাকুরি করবে, তাঁর তাৎক্ষণিক উত্তর। জামাইকে বলেছি, চাকুরি করতে দিতে হবে। তাঁর ছোট মেয়েটি এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
এরপর একটু গম্ভীর হয়ে জানালেন, গতবছর রোজার সময় তাঁর স্ত্রী মারা গেছেনে। এরপর তিনি নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। বুঝেও না বোঝার ভান করে জিজ্ঞেস করলাম, নতুন সিদ্ধান্ত মানে কী? একটু হাসি দিয়ে বললেন-বিয়ের।
আবার জিজ্ঞেস করলাম-কেন? আবার হেসে বললেন, মেয়ের মাকে অনেক ভালবাসতাম। সেই ভালবাসা অন্যকে দিতে পারবো না।
রওয়ানা হলাম। পড়ন্ত বিকেলে যখন দিনাজপুরের দিকে এগিয়ে চলছি, তখন ভাবছি–পুরুষতন্ত্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা ও বেঁচে থাকা অনেক পুরুষের কাছে নারীর সাথে সম্পর্কটা শুধু ক্ষমতার বা ভোগের নয়, আবেগের ও ভালবাসারও। এ আবেগ ও ভালবাসার কোনো প্রতিস্থাপন ৫৫ বছরের এক নিরেট গ্রামীণ মানুষ বাবুল আক্তারের জীবনে নেই বলে তাঁর বিশ্বাস।