শাশ্বতী বিপ্লব: শিক্ষার মান নিয়ে বাজার গরম গেলো দু’তিন দিন। কেউ জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের তুলোধুনা করলো তো কেউ মিডিয়াকে। কেউ পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে, তো কেউ পরিবারকে। রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়িও হলো বেশ।
শিক্ষার মান নিয়ে হতাশা নতুন নয়। এ নিয়ে লেখালেখি, সভা-সেমিনার হয় বিস্তর, কিন্তু কাজ কতটুকু হয় বলা মুশকিল। সমস্যা অনেক – পাঠ্যসূচীতে অসামঞ্জস্যতা, পাঠ্যপুস্তকের মান, পাঠদানের মান, পরীক্ষা পদ্ধতি, সৃজনশীল, এমসিকিউ, প্রশ্ন ফাঁস, কোচিং, নকল, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আছে বাংলা মিডিয়াম, ইংলিশ মিডিয়াম, ইংলিশ ভার্সন, মাদ্রাসা, ইংলিশ মাদ্রাসা, বাংলা মাদ্রাসা, আরবী মাদ্রাসা, আরো কত কী! ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর আবার ভিন্ন ভিন্ন মুরুব্বি, ভিন্ন ভিন্ন গ্রেডিং সিস্টেম। ভিন্ন ভিন্ন সিলেবাস, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির চর্চা।
আছে পাবলিক শিক্ষা, প্রাইভেট শিক্ষা। বিনামূল্য কিংবা উচ্চমূল্যের শিক্ষা। ভ্যাট দেয়া না দেয়া। আছে শিক্ষক আন্দোলন, বেতন স্কেল। লিস্টটা বেশ লম্বা।
এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সাধ্য আমার নেই, সেটা বিশেষজ্ঞদের জন্য তোলা থাক। আমি শুধু আমার কিছু অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির কথা বলবো।
আজকাল আমি আমার ছেলেদের সমবয়সী বাচ্চাদের মায়েদের এড়িয়ে চলি। গল্প করলেও বাচ্চাদের লেখাপড়া নিয়ে, ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলি না। এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি স্কুলকেও। আমার পাগল পাগল লাগে, অসহায় লাগে। ক্রিটিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থা, তার চেয়েও ক্রিটিক্যাল টিচার এবং ততোধিক ক্রিটিক্যাল অভিভাবকেরা আমার ভিতর কেবল হতাশাই তৈরি করে। নিজেকে আর আমার বাচ্চাদেরকে আনফিট মনে হয়।
আমাদের স্কুলগুলো দুষ্টু বাচ্চা পছন্দ করে না। একটু কম পারা বাচ্চা পছন্দ করে না। ভুলোমন বাচ্চা পছন্দ করে না। উদাসীন, ভাবুক বাচ্চা পছন্দ করে না। একটু ডাকাবুকো টাইপ বাচ্চা পছন্দ করে না। স্কুলের চাই ‘পারফেক্ট’ শিক্ষার্থী। ইমপারফেকশন (!) কে নিতে চায় না, নিতে জানে না স্কুল, অধিকাংশ শিক্ষক/ শিক্ষিকা। কেউ গতানুগতিক চেনা চরিত্রের বাইরে হলেই স্কুলগুলো কেমন যেন খড়্গহস্ত হয়ে ওঠে।
ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করা মাত্রই স্কুল বলে দিলো বাসায় বাচ্চার সাথে ইংলিশে কথা বলতে। চেষ্টা করতে গিয়ে হাসি পেল। কী ভীষণ আরোপিত আর মেকি! বাদ দিলাম। বাচ্চার সহপাঠীদের সিরিয়াস মায়েরা হাল ছাড়লেন না। ফলাফল, জগাখিচুরী ইংরেজী শব্দ ঢুকিয়ে বাংলিশে কথা বলা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছোটবোন মেয়েকে নিয়ে বাসায় বেড়াতে এলো। দুই বছর বয়সের ফুটফুটে পুচকুটা দেখালো তার টাং কোনটা, লেগ কোনটা, আই, হ্যান্ড, হেয়ার কোনটা -সব পারে। আমি প্রশংসা করতেই মা অভিযোগ করলো, কিছুতেই “কাউ” শেখাতে পারছি না, কোরবানির গরু দেখলেই বলে, গলু। কী মুশকিল। আমি মৃদু কণ্ঠে বললাম, বলুক না, অসুবিধা কি? সময় হলে সব ঠিক শিখে যাবে।
ছোটবোন প্রতিবাদ করে উঠলো, না, না, বাংলা শিখে কী করবে! স্কুলে তো ইংলিশই শিখবে, শুধু শুধু কনফিউজ করে ফেলবে। মেয়েকে “ওয়াটার” খাওয়ালো, “টয়” দিয়ে “প্লে” করতে বললো। আমি অসহায় তাকিয়ে দেখলাম। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে বাংলায় কথা বলা যাবে না, এই ধারণা আমাদের ভেতর গেঁথে দিয়েছে স্কুলগুলো।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো কারিকুলাম ধার করে পড়ায়। নিয়ে আসে ভিনদেশি লার্নিং ম্যাথড। শুধু আনতে পারে না শিক্ষার্থীর মনস্তত্ত্ব বোঝার মানসিকতা ও দক্ষতা। স্কুলে শিক্ষক/ শিক্ষিকারা ক্লাশের সেরা বাচ্চাটিকে টার্গেট করে পড়ায়। যে বুঝলো না তার দায় অভিভাবকের। ক্লাশের বেশি নম্বর পাওয়া বাচ্চার প্রতি টিচারের পক্ষপাতিত্বের যেমন কোন রাখঢাক নেই, তেমনি রাখঢাক নেই যে বাচ্চাটা কম পেলো তার প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশেও। সবাই টের পায়।
এতোটুকুন বয়সেই নম্বরের ভিত্তিতে ঠিক করতে শেখে কার সঙ্গে মিশতে হবে। ছেলে-মেয়ে, ধনী-গরিবের বৈষম্য চমৎকার ভাবে মাথায় বসে যায়। “বুলিং” কেবল বিশ্ববিদ্যালয়েই হয় না, এসকল কোমলমতি বাচ্চারাও শিখে যায় কার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে কোনো প্রতিকার হবে না। সচেতন বা অসচেতনভাবে “বুলিং” করেন টিচাররাও।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কো- এডুকেশন, ছেলেমেয়েরা একসাথে পড়বে, পরস্পরকে শ্রদ্ধা করতে শিখবে, বন্ধুত্ব করবে-এটাই সাধারণ ধারণা। কিন্তু বহু বিখ্যাত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলেই ছেলেমেয়েরা আলাদা বসে একদম ছোট ক্লাশ থেকেই। একই ক্লাশেরুমে থেকেও স্কুলের কড়া নজরদারিতে তারা শিখে যায় সমাজের তৈরি করে দেয়া বিভাজন। ছাত্রছাত্রীদের মনিটর করার জন্য আছে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা!!
এতো মনিটরিং এর মাঝেও কোন এক স্কুলের ক্লাশ ফাইভের ক্লাসরুমে কেউ একজন “F” দিয়ে একটি অশ্লীল শব্দ লিখে ফেললো। স্কুলের মাথা গরম। কে লিখেছে বের করতেই হবে, শাসনও করা দরকার, ভালো কথা। ক্লাশের প্রতিটি স্টুডেন্টকে জেরা করা হলো, কেউ স্বীকার করলো না, করার কথাও না। মাঝখান থেকে পুরো স্কুল কানাকানি। ক্লাশ ওয়ানের বাচ্চারা মাঝখান থেকে বোঝার আগেই শব্দটা শিখে ফেললো।
স্কুলের টিচার-প্যারেন্ট মিটিংখুবই চমৎকার একটি ব্যবস্থা। স্কুল বাচ্চাদের পারফরমেন্স নিয়ে কথা বলবে, অভিভাবকরা স্কুলের পারফরমেন্স নিয়ে পরামর্শ দিবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শিক্ষার্থীর না পারা নিয়ে কথা বলতে স্কুল/ টিচার যতটা আগ্রহী, স্কুলের বা টিচারের পারফরমেন্স নিয়ে ততটা নয়। অভিভাবক কোথাও দ্বিমত করলে বা পাল্টা পরামর্শ দিতে গেলেই বিপদ। এইসব অভিভাবকরা বেশিরভাগ ক্ষত্রে ব্ল্যাক লিস্টেট হয়ে যান।
এই মিটিং এ বাচ্চাকেও সাথে নিতে হয়, শিক্ষার্থীর সামনে বলা হয় তার সম্পর্কে মূল্যায়ন। কিন্তু স্কুল কথা বলার সময় টিচাররা বিরাট অভিযোগের ডালি খুলে বসে, বাবা-মাকেও একচোট ধুয়ে দেয়। বাচ্চা আপনার সামনে বিব্রত, আপনি বাচ্চার সামনে।
অপমান করা, লজ্জা দেয়া বা তুলনা করা ছাড়া আমরা ফিডব্যাক দিতে পারি না। না বড়দের, না ছোটদের। আমরা এখনো কিভাবে পজিটিভ ফিডব্যাক দিতে হয় শিখিনি। আমাদের দেশে টিচারদের এইসব প্রফেশনালিজম শেখানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। টিচার্স ট্রেনিং কোর্সে কী শেখায় আমার জানা নেই। তবে, শিশুদের মন বুঝতে শেখায় এরকম আমার কখনো মনে হয়নি।
কারিকুলামের চাইতেও ছাত্রছাত্রীর মানসিক গঠন বুঝতে পারাটা আমার কাছে জরুরি মনে হয়। সেখানেই বিরাট গলদ। আমাদের শিক্ষার্থীদের কমফোর্ট জোনের খুব অভাব। ব্রিদিং স্পেস প্রায় নেই বললেই চলে।
শিক্ষার্থীরা গাদা গাদা পুঁথি পড়া শেখে, শেখে না জীবনকে পড়া। ইতিহাসের সন-তারিখ পড়তে শেখে, মানুষগুলোকে নয়। বিজ্ঞানের সূত্র মুখস্ত করার চাপে বিজ্ঞানের মজাটাই হারিয়ে যায়!
সব মাধ্যমেই মানুষ শেখে – লেখাপড়া, প্রতিযোগিতা, আখের গোছানোর রসদ – কম আর বেশি। শুধু শেখার আনন্দটারই কেন যেনো বড় অভাব।
কি আর করবেন ম্যাডাম মনে কষ্ট নিয়ে থাকুন। দেথেন ভগবান রক্ষা করে কি না?