মিথিলা মাহফুজ: যারা জিপিএ ৫ প্রাপ্ত কয়েকজন শিক্ষার্থীর অপসাংবাদিকতা দ্বারা হেয় হওয়ার ভিডিও দেখে দারুণ মজা পাচ্ছেন এবং টিটকারি-ব্যঙ্গ করে নিজেদের স্মার্টনেস প্রমাণ করছেন, তাঁদের দেখে আমার ওইসব শিক্ষার্থীর চাইতেও বেশি করুণা হচ্ছে, সাথে ঘৃণাও।
জ্বী, আপনি আমার বন্ধুতালিকার একজন হয়ে থাকলেও আপনার প্রতি মনোভাব ভিন্ন না আমার। আপনাদের কাদের কতো জ্ঞান আছে তা ফেসবুকে হয়ত প্রমাণ হয়না, ফেসবুক চটুলতা এবং ‘শো-অফ’ এর বিশাল প্ল্যাটফর্ম, কিন্তু সামনাসামনি এবং ব্যাবহারিক কাজে আপনাদের অনেকের জ্ঞানই আমার দেখা হয়েছে। কাজেই আমার আপনাদেরকে ছি! বলতে সমস্যা হয়না।
বলেন, আপনারা এই ভিডিওর আগে দেশের শিক্ষার অবস্থা বিষয়ে জানতেন না? বলেন, আপনারা যারা অনেকেই এখনো শিক্ষার্থী তারা একই বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে আসেন নাই, যাচ্ছেন না? বলেন, আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন কোনদিন এই শিক্ষা ব্যবস্থা বদলাবার জন্য কিছু করেছেন? বলেন, কেউই কোনদিন নকল করেন নাই? কোনদিন কোন শিক্ষককে তেল দেন নাই? কেউই কোচিং করে, নোট কিনে, ফটোকপি করে পাশ করেন নাই? আপনাদের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় শিক্ষার্থীরা কি এই শিক্ষায়ই শিক্ষিত হচ্ছে না?
বলেন, এত এত ছাত্র সংগঠন আছে, সেখান থেকে কোন প্রতিবাদ, বিকল্প প্রস্তাব, আন্দোলন কেন হচ্ছে না? কেন গণহারে জিপিএ ফাইভ দেওয়া হচ্ছেকজহ এবং দেশের অর্থ এবং পররাষ্ট্র নীতির সাথে এর কি সংযোগ জানেন আপনারা?
এইসব ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকের সাথেই আমার ক্লাসে দেখা হয়, জানাশোনা হয়, তাদের আমি পড়াই। তারা অনেক কিছুই হয়তো জানে না। আবার আপনাদের অনেকের থেকে অনেক কিছু জানেও। অনেক গুণ এদের অনেকেরই আছে।
শিক্ষা বলতে কি “নেপালের রাজধানী কি?”, অথবা “আইনস্টাইনের সুত্র কি?” এইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তরই বোঝায়? বাহ, ভালোই শিক্ষা বিষয়ে বোঝেন তো আপনারা! শিক্ষা কি মানবিক গুণাবলী, ব্যবহারিক জ্ঞান, জানার কৌতুহল, সততা, লড়াকু চিত্ত, সহবৎ, ইত্যাদি বোঝায় না? সেগুলো কি আপনাদের মধ্যেই আছে? এদের জ্ঞানকে হেয় করার কে অধিকার দিয়েছে আপনাদের? এরা যে জ্ঞান নিয়ে আসে, এবং যে জ্ঞান এদের খাওয়ানো হয়, এবং শেষমেশ নেটওয়ার্কিং এবং তেলবাজি বাদে কোন জ্ঞানই যে আর কাজে লাগে না, তার জন্য কি ওরা শুধু দায়ী?
ওরা অনেকেই যখন কর্পোরেট অফিসে আপনাদের বস হয় তখন তো ঠিকই জ্বী স্যার, জ্বী ম্যাডাম করেন, নাকি?
কয়েকজনকে দেখলাম নিজেরা দৈনন্দিন জীবনে অনেক সাধারণ শব্দের সঠিক বানানও পারে না, একটা আবেদনপত্রও ঠিকমতো লিখতে পারে না, এমনকি দাপ্তরিক ডকুমেন্টে তারিখ বসানোর ফরম্যাট পর্যন্ত জানে না, কিন্তু ফেসবুকে কী অনায়াসে জঘন্যভাবে হাসাহাসি করছে!
ধিক্কার আপনাদের! নিজেরা ভুল বাক্যে পোস্ট লিখে, ভুল ধারণার প্রচারণা করে, এদেরকে ব্যঙ্গ করছেন, আপনাদের যে লজ্জায় মরে যাওয়া উচিৎ এই শিক্ষা তো আপনাদেরও নাই!
কী করেন আপনারা লেখাপড়া শিখে? কী শেখেন আপনারাও, শুনি? ওরা ওইসব প্রশ্নের উত্তর না জানলে শিক্ষিত না, ফেসবুকে এবং চায়ের আড্ডায় এই এলিটিস্ট ভাবসাব নিলে কী হবে, আসলে তো মননে এক একজন মূর্খ ঔপনিবেশিক ক্রীতদাস আপনারা, নইলে ঠিকই জানতেন, যে “আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ” একটা সঠিক ইংরেজি বাক্য!
ছি:!!!
যারা মাছরাঙা টিভির রিপোর্টটি দেখে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের ব্যঙ্গ করছেন তাদের প্রতি আপনার ঘৃণা প্রকাশ অত্যন্ত যৌক্তিক। কিন্তু ঐ কয়েকজন শিক্ষার্থীর একেবারে সাধারণ কিছু বিষয় না জানা কি খুব স্বাভাবিক? আপনি নিজেই শিক্ষা বলতে যা যা বোঝায় এর মধ্যে জানার কৌতুহল বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। যে শিক্ষার্থীর জানার কৌতুহল থাকবে সে নিজের দেশের স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস জানবেনা? যে পরীক্ষা সে দিল তার পূর্ণরূপ জানবেনা? যে জিপিএ ৫ নিয়ে সে এত গৌরবান্বিত হচ্ছে তার পূর্ণরূপ জানবেনা? আপনি ঠিকই বলেছেন,এরাই পরবর্তীতে কর্পোরেট অফিসে আমাদের কারো না কারো বস হয়ে আসবে, সেটা হবে আমাদের দূর্ভাগ্য। আমাদেরও অজানা অনেক কিছু আছে। এই যেমন আমি জিপিএ ৫ পেয়েছি এর ইংরেজি অনুবাদ I am GPA 5 -এটা সঠিক বাক্য এটা জানতাম না।
চিল লেডি, লুক্স লাইক ইউ নিড টু সি আ ডক্টর
সুন্দর আর যৌক্তিক লেখা। শুধু উষ্মাটা একটু প্রকট প্রকাশের ধার দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।