নারীবাদ অথবা নারী বাদ !

বিথী হক: নারীবাদ একটা মতাদর্শের নাম, একটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের নাম ।  বাংলা সিনেমায় দেখা নায়কের পিঠের উপর নায়িকার হাই হিল পরা পায়ে দাঁড়ানোর  নাম নারীবাদ নয় । যে সমাজ কথায় কথায় নারীদের অন্দরমহল চেনায় সে সমাজের  বিরুদ্ধে নারীরা সোচ্চার নাহলে, সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের ডাক না দিলে আজকে  আপনি আমি বাইরের হাওয়া গায়ে লাগাতে পারতাম না। 

Bithi Haque
বিথী হক

সুতরাং নারীবাদী বলে কাউকে নিয়ে হাসাহাসি করার আগে আপনার আরো কিছু  বিষয় জানা দরকার। আজকে আপনাকে যদি ভোট দেয়ার অধিকার না দেয়া হয়, বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করার অধিকার, পাবলিক বাসে ওঠার অধিকার না দেয়া হয় তখন কি করবেন? জ্বী, আজকে থেকে মাত্র  একশ বছর আগেই আপনার আমার ভোটাধিকার ছিল না । আজকে এই সময় হিজরাদের  ভোটাধিকার না থাকলে আপনার যেমন কোন মাথাব্যাথা হয় না, তৎকালীন পুরুষতন্ত্রও  একসময় নারীদের ভোটাধিকার নিয়ে তেমনি নিস্পৃহ ছিল।
শিক্ষাদীক্ষায় যে  আজকে আপনি-আমি ছেলেদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে ফার্স্ট-সেকেন্ড হচ্ছি, এটাও  একদিনের অর্জন না।

ভাগ্যিস বেগম রোকেয়া বলে উপমহাদেশে কেউ ছিল যে  স্বার্থপরের মত নিজে শিক্ষিত হয়ে বসে থাকেনি বরং অন্দরমহলের বাইরে এসে  নিজেই নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছিলেন ।  

ঘরের কাজ,  স্বামী-সন্তানের প্রতিপালন করেও আপনি যে সরকারি-আধাসরকারি-বেসরকারি অফিসে  পুরুষের পাশের ডেস্কে, তার সমান একই মাইনেতে, একই সময় ইনভেস্ট করে কাজ করার  সুযোগ পাচ্ছেন সেই সুযোগ আপনাকে আমাকে বাড়ি বয়ে এসে কেউ দিয়ে যায়নি । এটার  জন্য অনেক কাঠখড় পোড়ানো হয়েছে, সেটা আপনি পোড়াননি বলে আপনার গায়ে লাগছেনা  কিন্তু কেউ না কেউ কিন্তু পুড়িয়েছে ।

Feminism 4অনেকেই যুক্তি দেন, নারী আন্দোলন  যদি নারী পুরুষ সবাই মানুষ এবং একে অপরের সমকক্ষ হবার আন্দোলন হয় তো সেটা  মানবতাবাদ না হয়ে নারীবাদ কেন হলো? একই যুক্তিতে নারীদিবস পালনের জন্যও অনেকে সমালোচনা করেন । কথা হচ্ছে, আপনার পায়ের তলায় মাটি না থাকলে কিসের  উপর দাঁড়িয়ে গলা ফাটাবেন?

যে সমাজ পুরুষদের মানুষের স্ট্যান্ডার্ড ধরে, সেখানে নারীরা শুধুমাত্র একজন নারী, তারও অনেক পরে মানুষ । সুতরাং আপনি পুরুষদের মানুষের স্ট্যান্ডার্ডে ফেলেন আর নাই ফেলেন আন্দোলনটা মানবতাবাদী  আন্দোলন বলে চালিয়ে দেয়া যায় না। সব সেক্টরে পুরুষের সমান অধিকার আর স্বাধীনতা পেয়ে গেলে তখন মৌলিক ইস্যু নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করেন, সেটা  মানবতাবাদী আন্দোলন হবে।

যতদিন পুরুষকে ভাল না বেসে সমীহ করে বাঁচতে  হচ্ছে, সমন্বয় করে বাঁচার পরিবর্তে মন যুগিয়ে চলতে হচ্ছে ততদিন নারীবাদ  নিয়ে না বুঝে উল্টাপাল্টা কথা বলা বন্ধ করেন ।

যুগের পর যুগ আন্দোলন করে নারীবাদীরা আমাকে আপনাকে আজকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। যে পুরুষগুলোর গলায় গলা মিলিয়ে আপনি নারীবাদ আর নারীবাদীদের কথা শোনাচ্ছেন তাদের জন্যই আপনাকে ডমিস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার হতে হতো। সভ্য পুরুষরা নারীদের সভ্যতার অর্ধেক অংশই মনে করে । যারা আপনাকে ভুংভাং বুঝিয়ে  ঘরে থেকে কাজ করতে বলে, পুরুষকে সমীহ করে চলতে বলে সে  আর যাই হোক কখনোই  আপনাকে আপনার প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছেনা; যা দিচ্ছে সেটা করুণা । এই পুরুষরাই  আপনি ধর্ষিতা হলে, বন্ধ্যা হলে, তাদের জন্য রান্না না করে দিলে আপনাকে ঘর  থেকে বের করে দেবে ।

সুতরাং, কাউকে সমীহ করার আগে, কারো মিষ্টি কথায় গলে যাবার আগে নিজেকে সমীহ করেন। প্রকৃতি প্রদত্ত হাত, পা, চোখ, কান ব্যবহার করে নিজের অধিকার বুঝে নেন, তারপর নারীবাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আলাদা করে নারীবাদকে ঘৃণা করেন, তার আগেই দয়া করে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে নিজের অস্তিত্বের বিলোপ ঘটাবেন না প্লিজ ।

 

শেয়ার করুন:

ধন্যবাদ ওমেন চ্যাপ্টারকে। নারীদের লেখাগুলি পড়লাম। ভাল লাগলো কেউতো আমাদের নারীদের চোঁখে আংগুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে তোমরা কিন্তু তোমাদের অধিকার সম্পর্কে জানো না। না এবং জানার কারণে তোমরা আজ কত পিছনে দাড়িয়ে আছ।

অবশ্যই চমৎকার একটি লিখনি। নারীবাদের পূর্ব ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে এখানে আলোচিত হয়েছে। নারীদের পশ্চাদ পদতার কারণগুলো্ও জানা গেল। তবে একটি বিষয় মনে হয়, ভিন্ন রকম হলে ভাল হত। রচনাটা পড়ে মনে হচ্ছে লেখক যেন আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছেন, এবং কিছুকিছু বিষয়ের জন্য আমাকেই দোষারোপ করছেন। আমি নিজেকে একজন মানবাধিকার কর্মী বলে মনে করি। নারী অধিকার অবশ্যই মানবাধিকার। কিন্তু লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে লেখক আমার উপরও ঝাল ঝাড়ছেন। তাই লেখাটা প্রথম বা দ্বিতীয় পুরুষে না লিখে নাম পুুরুষে লিখলেই ভাল হত। কারণ, দ্বিতীয় পুরুষের কিছু কিছু বাক্য নারীবাদের বিরোধীরা কেবল অপছন্দই করবেন না, তারা অধিকতর শত্রু ভাবাপন্ন হয়ে যেতে পারে।

নারীবাদ নিয়ে লেখার উদ্দেশ্য খোঁচা দেয়া বলে মনে করি না। বরং বিষয়টির যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিরোধীদের সপক্ষে নিয়ে আসাই নারীবাদী লেখকদের উদ্দেশ্য হ্ওয়া উচিৎ। বেগম রোকেয়ার চেয়ে তসলিমা নাসরিন কোন অংশেই কম শক্তিশালী লেখিকা নয়। তার লেখার ভক্ত অনেকের মতো আমিও ছিলাম। কিন্তু তার নারীবাদের সাথে অসংগত লেখার জন্য আমিও তাকে আর পছন্দ করি না।

বেগম রোকেয়া অবরোধবাসিনী লিখে বোরখা প্রথার বিরুদ্ধে গড়্গ ধরেছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেও কিন্তু সব সময় মার্জিত পোশাক পরতেন, হিজাব এমনকি বোরখাও পরতেন। তিনি তার মতকে সার্বজনিন করার জন্য বেশ কষ্ট করেছিলেন।

নারীবাদ বা নারীর অধিকার হরণ যেমন বৈপ্লবিক উপায়ে হয়নি, তেমনি নারীর অধিকার পূনপ্রতিষ্ঠা্ও কোন বৈপ্লবিক পন্থায় হবে না। এটার জন্য দরকার সামাজিক বিবর্তনের। যে বিবর্তনের পথ নির্দেশ করবে নারী পুরুষ উভয়েই। গড়পড়তা সব পুরুষকে নারীবিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না, যাবে না।

আমাদের(পুরুষদের) মধ্যে সমস্যা অনেক, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আধিপত্য বিস্তার করার সহজাত প্রবণতাটা আমাদের মাঝে কিছু মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
রাতারাতি এর থেকে গোটা পুরুষ জাতিকে বের করে আনা কিছুতেই সম্ভব নয়।
সময় লাগবে, একই সাথে চাপটা অব্যাহত রাখতে হবে।
আমাদের মধ্যে যারা মুক্তমনা, তারাও অবচেতন মন থেকে রক্ষণশীল আর হীনমন্য। এটা অস্বীকার করার জো নেই।
তবে আমি হলফ করে বলতে পারি, একটা সময় সবকিছুই সুন্দর আর স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, আর সেটা আপনাদের মত নারীবাদীদের জন্যই।
womenchapter.com কে ধন্যবাদ জানাই সুন্দর একটা প্লার্টফর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার জন্য।

Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.