আত্মহত্যা নয়; সামাজিক হত্যাকাণ্ড

মাসকাওয়াথ আহসান: পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের নারীর বিকশিত হবার পথে প্রধান বাধা কন্যা সন্তানের মায়েরা। অত্যন্ত শিক্ষিত প্রগতিশীল মায়েরাও নিজের মেয়ের মনোজগতে একটিই লক্ষ্য স্থির করে দেন, তোমাকে বিয়ে করতে হবে। বিয়েটাই যেন নারীর জীবনের একমাত্র স্বপ্ন।

Sabira 1কন্যা শিশু বার্বি ডল নিয়ে খেলবে। এ হচ্ছে কন্যা শিশুর মনে ‘সন্তান’-এর ইনসেপশান তৈরী করা। পুতুলের বিয়ে; ছোট্ট খেলনা কিচেন; মিছামিছি বাবাকে ‘চা’ বানিয়ে খাওয়ানোর পর বাবা বলে থ্যাংক ইউ।

কন্যা শিশুর মনে যদি স্বপ্ন গেঁথে দেয়া যায় তুমি উচ্চশিক্ষিত হবে; যে কাজ তোমাকে আনন্দ দেবে তেমনি একটি পেশা বেছে না’ও। তোমাকে জীবন যাপনের জন্য কারো ওপর নির্ভর করতে হবে না; এরপর ভালোলাগা থেকে যদি কারো সঙ্গে ভালোবাসা তৈরী হয় তবে বিয়ে করো; এ তোমার ইচ্ছার স্বাধীনতা; তাহলে কন্যা শিশুর ওপর থেকে ভুল ব্যবস্থার তৈরী করা জগদ্দল পাথরটি সরে যাবে।
অনেক ক্ষেত্রে মা তার কন্যা শিশুর উচ্চশিক্ষা, পেশাগত সাফল্যের সহযোগী হলে এসে পড়ে পাশের বাড়ীর উপযাচক ভাবী কিংবা খালা-ফুফু সমাজ; এরা হচ্ছে সামাজিক পুলিশ সমাজ। এদের একটাই প্রশ্ন, ভাবী আপনার মেয়ের বিয়ে দিতেছেন না কেন! যেন নিজেরা বিয়ে করে এক-একটা বিশাল সফল জীবনের মডেল তৈরী করেছেন।

আর সেই আদিম যুগের মতো নারীর চেসটিটি (কথিত সতীত্ব) একটা বিরাট ট্যাবু হয়ে আছে। পুরুষ নিয়মিত ব্যাংককে হেলথ টুরিজম করে এসেও থেকে যাবে সাধুসন্ত হিসেবে। কিন্তু নারীকে একটি বিয়ে বাঁচানোর জন্য সীতার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে। এইসব চিন্তার আবর্জনাকে ঐতিহ্য বলে লালন করার মধ্যেই লুকিয়ে আছে নারীকে নিয়ে সমাজ চিন্তার স্টেরিওটাইপ।

ভারতীয় উপমহাদেশে আবার প্রেম কিংবা ভালোবাসার দ্বিতীয় দিনেই সম্পর্কের ডেফিনেশান দিয়ে দিতে হবে। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করবে, সম্পর্কটা বিবাহ পর্যন্ত গড়াবে কীনা। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে সেই বিবাহ এবং সন্তান উৎপাদনের বিপ্লবের স্বপ্ন।
এইখানে আবার মেয়ের মা ফলিত অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ। সে-ও মেপেজোখে দেখবে এই ছেলেটা জীবনে কতটুকু সফল হবে। সাফল্য মানে ঐ যে টেকাটুকা-গাড়ি-এপার্টমেন্ট-বিদেশ ভ্রমণ করানোর সামর্থ্য। ছেলেটি এইসব সূচক পূরণে ব্যর্থ হলে; উচ্চ মধ্যম আয়ের পাত্র খুঁজে দেবে সমাজের নান্টু ঘটক মামুরা। সেই ক্ষেত্রে উচ্চ মধ্যম আয়ের পাত্র না হওয়ায় রেস থেকে ছিটকে যাওয়া প্রেমিক দেবদাস হয়ে যাবে। কারণ তাকেও কোন বিকল্প স্বপ্নের শিক্ষা তার বাবা দেয়নি।

যেহেতু বিয়েই জীবনের একমাত্র স্বপ্ন; প্রেমিক বিয়েতে রাজী না হলে অতি-আবেগী হয়ে আত্মহত্যার ট্র্যাজেডি। কারণ আর কোন স্বপ্নের কথা সে তো জানে না।
এই আধা গ্রাম্য-আধা মেট্রোপলিটান সমাজের সমস্যা হচ্ছে এখানে আধুনিক হবার ইচ্ছা আছে; কিন্তু নক্সী কার্পেটের নীচে থক থক করছে কুচিন্তার কাদা।
শৈশব থেকে শিশুদের পড়াশুনার পাশাপাশি সৃজনশীলতার একটি আকাশ প্রয়োজন। পড়ালেখা-পেশা-বিয়ে যদি জীবনের ঘর হয়; ক্রীড়া-সাহিত্য-সংস্কৃতি-বিতর্ক-সঙ্গীত-বিজ্ঞান গবেষণা-সমাজ সেবা এগুলো জীবনের ব্যালকনি। মানুষের জীবনে যদি সৃজনশীলতার ব্যালকনি না থাকে; বদ্ধ ঘরে সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবার উপক্রম হয়। এ হয় জীবন্মৃত জীবন। আমাদের ভুল সমাজ-ব্যবস্থা, আবদ্ধ চিন্তার গ্যাস চেম্বার ঐ অনন্যোপায় ঘরখানা। সেখানে দিক নির্দেশনাহীন যে কোন তরুণ বা তরুণী আত্মহত্যা করতেই পারে। একে আমরা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিলেও এটি আসলে তামাদি হয়ে যাওয়া সমাজ রাক্ষসের হত্যাযজ্ঞ। আমরা সবাই সে মানবতাবিরোধী অপরাধের এপোলজিস্ট।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.