মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর

জেসমিন চৌধুরী: ছোটবেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটি ছিল হিন্দু, নাম অরুণা। অসম্ভব লক্ষ্মী শান্ত স্নিগ্ধ স্বভাবের একটি মেয়ে। আমাকে খুব পছন্দ করতো। আমি দেখতে সুন্দর কথাটা প্রথম আমি অরুণার মুখেই শুনেছিলাম।

বলতো, ‘তোরে দেখতে খুব মায়া লাগে’। সিলেটিতে মায়া মানে হচ্ছে মিষ্টি। আমার মা’র সাথে  অরুণার কোথায় যেন একটা অদ্ভুত মিল ছিল, দু’জনেই ভীষণ নরম আর কোমল, কোনো সাতে পাঁচে নেই, সারাক্ষণ সবাইকে খুশি করতে ব্যস্ত।  

baba 3আমার পৃথিবীতে এই দু’জন মানুষই ছিল যাদের মধ্যে আমি সত্যিকারের মমতা দেখতাম, অথচ অন্যরকম করে দেখলে এরা দু’জন ছিল  ভীষণ আলাদা। মা বলতেন, যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না, তারা সবাই দোযখে যাবে।  অরুণাকে নিয়ে  আমার দুশিচন্তার অন্ত ছিল না, মরার পর সে অনন্তকাল ধরে দোযখের লেলিহান শিখায় পুড়বে, তাকে সাপে কাটবে, বিচ্ছু কামড়াবে ভেবে ভীষণ কষ্ট লাগতো।  

মায়ের কথা অবিশ্বাস করতে পারতাম না, কিন্তু এমন লক্ষী একটা মেয়ে, যে কিনা নিজের ইচ্ছায় হিন্দু ঘরে জন্মায়নি, অনন্তকাল ধরে দোযখে পুড়বে তা’ও মেনে নিতে পারতাম না। আমার শৈশবের বেশির ভাগ অংশ কেটেছে এই নিয়ে বিভ্রান্তিতে।

স্কুলের যে দু’জন শিক্ষককে আমার ভাল লাগতো তারাও হিন্দু ছিলেন- আমাদের স্কাউট শিক্ষক নিকুঞ্জ বিহারী স্যার, যিনি কখনো কোনো কটু কথা বলতেন না এবং মজার মজার খেলা শেখাতেন, এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক হরিপদ স্যার, যিনি দেখলেই ধমক দিতেন। কিন্তু তাঁর স্নেহমাখা ধমকও কী যে ভাল লাগতো। তাদেরকে নিয়েও অনেক ভাবতাম আমি।

মা বলতেন, হিন্দুদের মধ্যে যারা ভাল মানুষ তারা এই পৃথিবীতেই তাদের ভাল কাজের পুরষ্কার পাবে, মৃত্যুর আগে আল্লাহর প্রতি মৌখিক এবং ব্যবহারিক বিশ্বাস না আনলে তাদেরকে দোযখে যেতেই হবে। জীবন মরণ, পাপ-পূণ্য নিয়ে আমার বিভ্রান্তির শুরু তখন থেকেই, তাই নিজের জন্য স্বর্গ কামনা করতে পারিনি কখনো।

আমার মা কখনো স্কুলে যাননি, বাসায় ভাইদের কাছে পড়াশুনা শিখেছিলেন। কিন্তু মা অনেক বই পড়তেন, আমাদেরকে অনেক গল্প বলতেন, নিষ্ঠুর রাজাদের গল্প, দয়ালু দৈত্যের গল্প, মহান মানুষদের গল্প। আমার প্রথম শিক্ষক মায়ের এইসব গল্প থেকে আমি মানুষকে, পশুকে, প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখেছিলাম।

Jesmin Chowdhuryঅথচ সেই মা’ই যখন ধর্মের কথা বলতেন, তাকে ভীষণ নিষ্ঠুর মনে হত। এমনকি আমার আদরের কুকুর টমিও আমার সাথে বেহেশতে যাবে না জেনে আমার চোখ ফেটে কান্না আসতো। সেই ছোটবেলাই যুক্তিহীন কোনো কথা মেনে নিতে পারতাম না, আবার অস্বীকার করার মত সাহস বা জ্ঞানও ছিল না। শুধু ছিল ভাবনা, নিরন্তর অনুত্তরিত ভাবনা।

পাঠ্যবইতে পড়া একটা কবিতা আমার মনকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল, আশার স্বপ্ন দেখিয়েছিল,

‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?

মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!’  

আশৈশব এই পৃথিবীতেই স্বর্গ গড়ার স্বপ্ন দেখেছি, চেষ্টাও করেছি। সেই স্বর্গ গড়তে গড়তেও ভেংগে গেছে বারবার যখন মুসলমান বন্ধুদের বলতে শুনেছি, হিন্দুদের হাতের রান্না মুরগী না খাওয়াই ভাল, আবার যখন হিন্দু বন্ধুদের মায়েদেরকে পুজোবারে নিজেদের রান্নাঘর আমাদের কাছ থেকে আগলে রাখতে দেখেছি। আমরা সবাই মিলেমিশেই থাকতাম, অথচ মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারতাম না।

অদৃশ্য সব দেয়াল উঠে গিয়ে আমার স্বর্গের স্বপ্ন ভেংগে দিত বারবার। তবুও আমি আবার স্বপ্ন দেখতাম। আজো দেখি।

আমি কবিতা লিখতে পারি না, তাই শৈশবের এসব ভাবনা নিয়ে লিখা কয়েকটি পংক্তিকে আমি ‘কবিতা নয়, শুধুই ভাবনা’ নাম দিয়েছি।

অভিজিতের মৃত্যুর মতো কোন ঘটনা ঘটলেই

অরুনার কথা মনে পড়ে যায়

আমার ছোটবেলার প্রিয় বান্ধবী অরুনা

যে আমার সাথে আরবি পড়তে  যেতনা

আকাশে বিজলী চমকালে বুকে থুথু দিত না

আকাশমুখি হয়ে পড়ত না ‘লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা’

রমজান মাসে কলসিতে রেখে

দিনে দুটো রোজা রাখার সাথী ছিল না যে অরুনা

সে আরো নানানভাবে ছিল ঠিক আমারই মতো

ফর্সা রং, কাঠি কাঠি হাত পা, উসখো খুসকো চুল

তর্জনীর নখের ভেতরে কালো আলকাতরা,

বড় রাস্তায় পীচ খুঁটে খুঁটে।

একদিন রাতের দেয়ালে আলোছায়ার খেলা দেখতে দেখতে জানলাম

আমি আর অরুনা ভীষণ  আলাদা,

আমরা পানি আর অরুনারা তেল

আমরা লোহা আর অরুনারা কাঠ

আমরা পূণ্য আর অরুনারা পাপ

মায়ের মিষ্টি গলার সুর করে পড়া আয়াত শুনে আমি অনেক কেঁদেছি

আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি অরুনাকে

সেই চোখ মুখ নাক

সেই ফিতা বাঁধা চুল

সেই অমলিন হাসি

সেই টানা টানা চোখে

সেও কি তাকায়?

সেও কি খুঁজে ফেরে অনুপস্থিত সব অসাদৃশ্য?

সেও কি জেনেছে আমরা যাচ্ছি ভিন্ন স্বর্গে?

অথবা নরকে?

আমি মসজিদে যাই

অরুনা শ্লোক পড়তে শেখে

ধীরে ধীরে আমরা দুজন শিশু থেকে ধার্মিক হয়ে উঠি

আর ক্রমশই পাপী হয়ে উঠি পরস্পরের কাছ

তবু আমি মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে ভাবি

অরুনাকে রেখে আমি বেহেস্তে যাবো না।

একদিন পূজোবারে মাসীমার ঘরে ঢুকে

মাটি করে দিই ঠাকুরের ভোগ

সবাই হাহা করে উঠলে আমি আর অরুনা পালিয়ে যাই

ভাঙা মন্দিরের শেওলা পড়া দেয়ালে বসে

মসজিদ থেকে চুরি করে আনা হালুয়া শিন্নি খাই

বনে বনে খুঁজি দোপাটির ফুল

মুখে টিপে নিয়ে কানে পরি দুল

আমাদের চারপাশে স্বর্গ নেমে আসে

জন লেননের স্বর্গ

অভিজিতের স্বর্গ।

অরুনার আর আমার স্বর্গ।

লেখক: জেসমিন চৌধুরী

(Cambridge CELTA )

Freelance ESOL tutor, Interpreter and Translator

 

শেয়ার করুন: