আজকের শিশু, কালকের এমপি

জেসমিন চৌধুরী: একটা বিশ্রী সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা, আমাদের আত্মমর্যাদা আজ আহত, নীরবে সরবে কাঁদছে কান ধরে উঠবস করা সমগ্র বাংলাদেশ। এরকম সময় একটা কৌতুক জমবে ভাল, কি বলেন?

গতিসীমার অনেক উপরে গাড়ি চালানোর জন্য আদালতে বিচার হচ্ছে এক নাগরিকের। বিচারক দু’দিকের যুক্তিতর্ক শোনার পর তার চশমাটি নাকের উপরে ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘আপনার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, আপনার বেপরোয়া আচরণ যে কারো মৃত্যুর কারণ হতে পারত। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’

Jesmin Chowdhuryউপস্থিত সবাইকে হতবাক করে দিয়ে বিচারক শাস্তি ঘোষণা করলেন, ‘আপনি এক হাজার বার লিখুন, আমি আর কখনো গতিসীমার উপরে গাড়ি চালাবো না। এটাই আপনার শাস্তি।’  এরকম অদ্ভুত শাস্তি তিনি কেন দিলেন, সেকথায় পরে আসছি। এখন একটু অন্য কথা বলি।

প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরিয়ে উঠবস করানোর ভিডিওটা আমি দেখিনি, রুচিতে বেঁধেছে। যে ঘটনায় দেশ-বিদেশের সকল বাংগালীর আত্মমর্যাদায় এতোটা আঘাত লেগেছে তা কিভাবে নিজ ইচ্ছায় দেখা যায়  আমি জানিনা। ফেসবুকের পাতায় পাতায় জলবসন্তের মত ছড়িয়ে যাওয়া ছবিটায় চোখ বুলানো অবশ্য এড়াতে পারিনি।

একদল অমানুষের মাঝখানে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায় চেহারার স্যারের ছবিটা দেখে যেমন কষ্ট লেগেছে, তেমনি মনে জেগেছে হাজারো প্রশ্ন।  স্মৃতির হাত ধরে হেঁটে গেছি অনেকটা পেছনে। মনের আর্কাইভ থেকে  প্রায় ভুলে যাওয়া অনেক ছবি উঠে এসে আমার চিন্তাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। আমার মনকে বিক্ষিপ্ত করেছে।

মনে পড়েছে প্রাইমারী স্কুলের দিনগুলোর কথা যখন ক্লাসের কোন এক দেয়ালের পাশ ঘেঁষে প্রায় প্রতিদিনই কয়েকটি ছেলেমেয়ে পেছন দিক থেকে দুই হাঁটুর নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কান ধরে বেঙের কায়দায় বসে থাকত। আমরা বলতাম চেংগি মেরে বসা। কান থেকে হাত ছুটে গেলে স্যার এসে জালি বেত দিয়ে পিঠে বাড়ি মারতেন। এক্ষেত্রে তৃতীয় পুরুষের ব্যবহার বাহুল্য কারণ ভীষণ চঞ্চল ছিলাম বলে ওই দোদুল্যমান বেঙের সারিতে প্রায়ই আমাকেও দেখা যেত। এই অবস্থায় ভারসাম্য রাখা কঠিন হতো বলে আমরা হাস্যকর ভাবে সামনে পেছনে দু্লতাম। কখনো কখনো পড়েও যেতাম। বেঞ্চে বসে থাকা ভাল ছেলেমেয়েরা স্যারের সাথে গলা মিলিয়ে আমাদেরকে নিয়ে হাসতো।  একবার নতুন আসা একটা ছেলে ঔ অবস্থায় প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিল। গোবর দিয়ে লেপা মাটির মেঝে দিয়ে যখন গড়িয়ে যাচ্ছিল সেই দুর্গন্ধযুক্ত পানির ধারা, তখন আর কেউ হাসছিল না।

ক্লাসরুমের অভূতপূর্ব নীরবতা ভাংগল ছুটির ঘন্টা বাজলে। সবাই যখন বাইরে  ছুটে গেল খেলতে, নতুন ছেলেটা তখনো পাথরের মত বসে ছিল তার নিজের প্রস্রাবে ভিজে যাওয়া মাটির উপর। স্কুল জীবনের এরকম বিভিন্ন কষ্টের এবং অপমানের দৃশ্য সারাক্ষণ মনে নিয়ে জীবন বাঁচা যায় না বলেই এগুলোকে আর্কাইভে তুলে রাখতে হয়। তবু কখনো-সখনো তারা জীবন্ত হয়ে উঠে পুরোনো ঘায়ে নতুন করে নুন ছিটাতে থাকে।

এবার কৌতুকটা শেষ করি। তো সেই বিচারক চশমা খুলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দেখুনতো স্যার আমাকে চিনতে পারেন কি’না। আমি আপনার এক দুষ্টু ছাত্র। কোন দুষ্টুমি করলেই আপনি আমাকে সেই বিষয়ে একটি বাক্য এক হাজার বার লিখতে বলতেন। আমিও আজ আপনাকে একই শাস্তি দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।’ ’

মূল কথায় ফিরে আসি। আমার ক্লাসের সেই ভয়ে প্যান্ট ভেজানো ছেলেটা এখন বড় হয়েছে, আমারই মতো বয়স, এই ধরুন পঁয়তাল্লিশ/ছেচল্লিশ হবে। যদিও তার সাথে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ নেই, আমি শুনেছি সে এখন একজন বড় ব্যবসায়ী এবং নানান রকম সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত। কে জানে একদিন সেও হয়তো এমপি-টেমপি হয়ে যাবে। তখন যদি সে তার নিজের প্রতি অথবা অন্যের প্রতি সন্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়, সেই ব্যর্থতার দায় কে নেবে?

শ্যামল কান্তি স্যারকে যখন চরমভাবে অপমান করা হচ্ছিল, তখন তার প্রতিবাদ জানানোর পরিবর্তে ভিডিও করতে ব্যস্ত ছিল যে দানবগুলো, তারা অথবা তাদের দানবগুরু সেলিম ওসমান নিশ্চয়ই আগের রাতে বৃষ্টির সাথে আকাশ থেকে পড়েনি। তাদেরকে আমরাই সৃষ্টি করেছি। বহুদিনের অজ্ঞানতা আর অবহেলায় আমাদের  দেশটা  আজ একটা দানব তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। নানান আকারের সেই দানবদের অত্যাচারে দেশের আত্মা আজ মরতে বসেছে।

সেলিম ওসমানকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করতে হবে নিঃসন্দেহে, কিন্তু একটা মাত্র দানবের শুঁড় কেটে কি আমার দেশ দানবমুক্ত হবে? ধ্বংস করতে হবে দানবের কারখানাকে, পরিবর্তন আনতে হবে গোঁড়ায়। মনে রাখতে হবে আজ যে ছাত্র, কাল সে শিক্ষক, আজ যে শিশু কাল সে এমপি হতেই পারে। আর শ্রদ্ধা পেলেই তারা শ্রদ্ধা করতে শিখবে। এর কোন বিকল্প নেই।

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.