জেসমিন চৌধুরী: ছোটবেলা আমার চার বছরের বড় ভাইকে যখন সাইকেল কিনে দেয়া হয়েছিল, এবং আব্বা তাকে নিয়মিত বিকেল বেলা চালানো শেখাতেন আমি লোভীর মত তাকিয়ে থাকতাম। আমাদের যথেষ্ট আধুনিক বাবা আমাকে সাইকেল দেয়ার কথা একবারো ভাবেননি। আমাদের আশেপাশের কোন মেয়েই তখন সাইকেল চালাতোনা। সেটাকেই ছিল স্বাভাবিক। বড় ভাইদের সাইকেলের ক্যারিয়ারে চড়ে অথবা পেছনে ছুটাছুটি করেই আমরা খুশি ছিলাম।
কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে দৃশ্যপট পাল্টে গেল। আমাদের আব্বার টিলাবাড়ির যে আকাবাঁকা পথ ধরে আগে আমার ভাই সাইকেল চালাতো, সেই পথ ধরে গাড়ি চালিয়ে উঠতে লাগলাম আমি। নব্বুইয়ের দশকের কথা বলছি। রক্ষণশীল শহর বলে পরিচিত সিলেট শহরে তখন যে দুইতিন জন মহিলা গাড়ি চালাতেন তাদেরকে পুরুষ চালকদের হাতে অনেক হয়রানি পোহাতে হত। ছোটখাটো ঝামেলা হলে যখন কেউ বলত, ‘মেয়েমানুষ গাড়ি চালালে তো এমনটা হবেই’, আমি নীরবে গাড়ি চালিয়ে চলে যেতাম। ‘একশন স্পিকস লাউডার দ্যান ওয়ার্ডস’ এ আমি বিশ্বাস করি।
ভাইরা যখন ড্রাইভার চালিত গাড়িতে চড়তেন, আমি তখন আমার রূপালী রঙের টয়োটা স্টারলেট নিয়ে সারা শহর চষে বেড়াতাম, বাচ্চাদের নিয়ে লং ড্রাইভে যেতাম, যে কোন ঘুঁপচি গলিতে অনায়াসে ঢুকে যেতাম। যে বাবা ছোটবেলা আমাকে সাইকেল কিনে দেননি তিনিই তখন আমাকে নিয়ে গর্ব করতেন। আমি কত ভাল চালাই, কিভাবে ভিড়ের মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে যানযট ভাঙাই তা অন্যদের কাছে গল্প করতেন।
মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে মানুষের চিন্তা ও কাজে বহু পরিবর্তন এসেছে । আরো আসবে। এসব পরিবর্তনে উৎসাহিত হয়ে অনেকে বলেন নারী দিবসের কি প্রয়োজন, বছরের তিনশ’ পয়ষট্টি দিনই নারীর। কিন্তু আমি বলব নারী দিবসের প্রয়োজন এখনো আছে কারণ পরিবর্তনের বাতাস সব ডালে আজো লাগেনি। পৃথিবী জুড়ে নারীরা আজো অধিকার বঞ্চিত। তবে সময় একদিন অবশ্যই আসবে যখন মানুষকে নারীর অধিকার মনে করিয়ে দেবার জন্য একটা বিশেষ দিন পালন করতে হবে না। আমরা সেইদিনের দিকে তাকিয়ে কাজ করে যাব।
আমি বক্তৃতার নারিবাদীতায় বিশ্বাস করিনা। আমি মনে করি নারীমুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন, এবং সেটা শুধু বড়বড় চাকুরী করার মধ্যে বা অর্থনৈতিক মুক্তির মধ্যে নয়, বরং একজন নারী তার জীবনে যা করতে চায় তা করার এবং যেভাবে বাঁচতে চায় সেভাবে বাঁচার ক্ষমতা অর্জনের মধ্যেই নিহিত আছে।
তাই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে সাইকেল চালানো শেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি যদিও খুবই কঠিন মনে হচ্ছে ব্যাপারটাকে। বলা হয় মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। ইদানিং আবার বলা হচ্ছে ফর্টি ইস দ্য নিউ থার্টি। কিন্তু আমি এখনো সাইকেলে উঠে বসার সাহস কুলিয়ে উঠতে পারিনি। মনের যৌবন সবসময় খুব সহজে বয়সের বার্ধক্যকে জয় করতে পারেনা। একদিকে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জমে উঠা মেদের ভার, তার উপরে আছে পড়ে গিয়ে জেলি শুকিয়ে যাওয়া লাম্বার ফাইভের স্থায়ী ক্ষতির সম্ভাবনা।
তবে এখনো হাল ছাড়ছি না। আমার পঁচিশ বছরের ছেলে ইবে থেকে অনেক ঘেঁটেঘুঁটে আমার জন্য উপযোগী চমৎকার একটি সাইকেল কিনে দিয়েছে। ছেলের পরামর্শে পেছন দিকে লাগানোর জন্য সাপোর্টিং হুইলও কিনেছি, যা ঠিকমতো বসছেনা বলে সে আবার চারটে ওয়াসার কিনেছে চাকাগুলোকে মজবুত করে লাগানোর জন্য। আমি এসব ঠিক বুঝিনা কিন্তু আমার একটি আশৈশব স্বপ্ন পূরণের জন্য আমার ছেলের এই চেষ্টা, আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তার এই উদ্বেগ জীবনের অনেক অপূর্নতাকে ভুলিয়ে দিয়ে এক ঝলক রোদের উষ্ণতায় ভরে তুলেছে আমার মনের উঠোন।
বাবার কাছে সাইকেল চালানো শিখতে পারিনি তো কি হয়েছে, ছেলের কাছে শিখবো। কোন সোনালী সকালে পুরো পরিবারকে নিয়ে নর্থ ওয়েলসের কোন পাহাড়ে গিয়ে মাউন্টেইন বাইকিং করবো, সেই স্বপ্নই এখন দেখছি।