হেঁশেলের ঘানি টানা মা আমার

তামান্না স্বর্ণা: আমার মা খুব সাধারণ পরিবারের একজন মেয়ে সবাই বলে আমার মা আমার নানার মতো হয়েছে রূপে-গুণে, আচার-ব্যবহারে প্রতিদিন নিয়ম করে ভোরে হেঁশেলে ঢুকতেন কখন বের হতেন আমার মনে নেই

Maaএকজন আদর্শ স্ত্রী এবং পুত্রবধূর যে অলিখিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সব তিনি পালন করতেন তবু তার কম হেনস্তা হতে হতো না নিজের কোন ইচ্ছা-অনিচ্ছা ছিল কিনা কেউ জানত না সারাদিন না খেয়ে থাকলেও কেউ জিজ্ঞাসা করতো না তাকে সবসময় হাসিমুখে থাকতে হবে, মুখ ভার করে থাকা যাবে না নাহলে ওপরের মহল নারাজ হবেন

মাঝে মাঝে ঘুমানোর জন্য বালিশ না পেলে পিঁড়ি মাথায় দিয়েও শুতে হতো মাঘ মাসের শীতে কখনও কখনও কাঁথাও জুটতো না আমার বাবার সামান্য সরকারি চাকরি, নিজের সহ ভাই-বোনের সংসার টানতে হতো যখন আমাকে স্কুলে ভর্তি করানোর সময় হলো আমার বাবা আমার স্কুলের বেতন দিতে অস্বীকৃতি জানালেন, আমার মাকে বেতনের টাকা যোগাড় করতে বললেন

আমার মায়ের প্রচণ্ড আত্মসম্মান, এরপর থেকে দুইটার বেশি শাড়ি পরতেন না আমাদের তিন ভাইবোনের পড়ালেখা নিয়ে কখনও আমার বাবা গা করতেন না আমার মা রান্নাঘর সামলে রোগীর সেবা করে আমাদের পড়াতেনও আজ আমরা তিন ভাই বোন যাই হই না কেন সবটাই আমার মায়ের জন্য সম্ভব হয়েছে

আজ আমার বাবার খুব গর্ব হয় আমি জানি, কিন্তু আসল গর্বটা কার?

আমার মাকে কোনদিনও শখ করে কিছু কিনতে দেখিনি, এখনও দেখিনা তার কি শখ নেই নাকি মরে গেছে জানি না বাবার সংসারেও ছিলেন বড়বোন, আর স্বামীর সংসারের কথা কিছু বলার নেই কালে ভদ্রে তাকে তার বাড়িতে যেতে দেয়া হতো ফিরে আসলে স্বামী শাশুড়ির মান ভাঙ্গানোর জন্য অজস্র রজনী চোখের জল ফেলতে হত যদি কখনও তার বাবার বাড়ির কেউ আসত আমার বাবার মুখভার হয়ে যেত আমার মা বোধহয় ভয়ে তার বাপের বাড়ির মানুষের সাথে ঠিকমতো কথাও বলতো না আমাদের ছোট হৃদয়ও মায়ের কষ্টটা বুঝতে পারত, কিন্তু আমাদের কিই বা করার আছে

আমার দাদীর খুব শখ ছিল আরেকটা নাতির কিন্তু যখন তার নাতনি হল দোষটা কেন জানি মায়ের হল জন্মের পর একবেলাও বোধহয় ঠিকমত খাওয়া হয়নি আর চোখের জলের বোধহয় কোন বাঁধ ছিল না

আমার দাদীর ক্যান্সার, টিউমার পেকে একাকার অবস্থা প্রতিদিন ড্রেসিং করানো লাগত পুঁজ, মরা কোষ, রক্তে একাকার অবস্থা হতো, রুমে বাথরুম করতো, এইসব কিছু আমার মায়ের পরিষ্কার করা লাগতো যার মা সে সুন্দর করে পাশে বসে থাকতো তাও ছেলের নাম হতো, ছেলের বউয়ের না

কি জানি আমি সংসারের হিসাব বুঝিনা আমার বোন একবিংশ শতাব্দির মেয়ে, তারও দেখি শ্বশুর বাড়ির মন যুগিয়ে চলার আগ্রহ  নাহলে কপালে জুটে খারাপ বউয়ের খেতাব

নারীর জীবন কি এভাবেই যাবে?? তার জন্মই কি পরের জন্য, নিজের বলতে কিছু নেই? উত্তরটা আমার জানা নেই

মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্ম হয়ে একটা জিনিস শিখেছি, সেটা হলো নিজের আবেগকে কিভাবে গোপন করতে হয় তাই আজ ২৩ বছর পেরিয়ে কখনও বলতে পারিনি মা তোমাকে ভালবাসি

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.