কন্যারা সব আলোর মশাল জ্বালো…..

মলি জেনান: কতদিন লেখার সাথে যোগাযোগ নেই অথচ কাগজ আর বর্ণমালার সাথে সখ্যতা আমার সেই ছোটবেলা থেকেই। অজপাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম; বাবা স্কুল শিক্ষক ছিলেন আর তাঁর ছিল ঘর ভর্তি বই (এখনো আছে) সেখান থেকেই আমার তথাকথিত অকালপক্ক হয়ে উঠা।

সেই স্কুল জীবনেই গল্পগুচ্ছ, শরৎ রচনাবলী, বঙ্কিম রচনাবলী, নীহারঞ্জন গুপ্ত থেকে শুরু করে হাতের কাছে যাই পেয়েছি তাই গোগ্রাসে গিলেছি। স্কুল ছেড়ে যখন কলেজে উঠলাম চারপাশে নতুন দিগন্ত খুলে গেল যার কাছেই বই পাই, নিয়ে পড়ি আর যতটা কেনা সম্ভব কিনি। আর ছিল লেখার অভ্যাস যা মনে আসত তাই লিখতাম ডায়েরি, চিঠি।

IWD 3আমার মা কতবার যে ওগুলো পড়ে পড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে আর আমি নিজের লেখা হারানোর যন্ত্রণায় ও মার বকা খেয়ে অঝোরে কেঁদেছি তার হিসেব নেই।

একদিন হাতে পেলাম তসলিমা নাসরিনের ‘নির্বাচিত কলাম’, খুব চমৎকৃত হলাম! তা ছিল একেবারেই সাধারণ সাদামাটা আমার কথা এবং আমি জোর দিয়েই বলতে পারি তা প্রত্যেকটা মেয়ের মনের কথা। আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম এই ভেবে যে- যে কথাগুলো, যে অভিজ্ঞতাগুলো আমরা লৌকিকতা, সামাজিকতা আর সংস্কারের ভয়ে যুগ যুগ ধরে আড়াল করে নিজের অপমান আর কষ্টকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়ে ভালো মেয়ে(!) হবার চেষ্টা করে গেছি তসলিমা নাসরিন সেই প্রবঞ্চনা, অপমান আর বৈষম্যকে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়েছেন। আর এই কারণটিই আমাকে তার লেখার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে যথেষ্ট ছিল।

শুধু আমার/আমাদের বৈষম্য, যন্ত্রণার কথা লিখতে গিয়ে একটা মানুষের ঘর, সংসার, সমাজ এমন কি দেশ নেই!!! ভাবলেই বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করি!  

Meye 1আমার চারপাশ তাঁর নিজের অজান্তেই আমাকে স্রোতের বিপরীতে হাঁটতে শিখিয়েছে। স্রোতের অনুকূলে থেকে খুব দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছুবার চেয়ে বিপরীতে থেকে একটু একটু করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকেই আমি সব সময় প্রাধান্য দিয়েছি। এর জন্য আমাকে অনেক কাঠ খড় পুড়াতে হয়েছে, হচ্ছে।

স্নেহময়ী-করুণাময়ী-লক্ষ্ণী এবং তথাকথিত ভালো মেয়ে হবার ইচ্ছেটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছি সেই কবেই তবুও নিজেকে বঞ্চিত, অপমানিত হতে দিইনি। এই পথ কখনোই সরল ছিল না বাধাটা এসেছে নিজের একান্ত আপনজনদের কাছ থেকেই। যুগ যুগ ধরে এই সমাজের মননে মগজে একটু একটু করে মহীরুহ হয়ে উঠা পুরুষতন্ত্র আমার ধৃষ্টতায় হুঙ্কার করেছে, ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছে আমায়, অথচ আমি আছি, থাকব চিরন্তন সত্যের মত!

হ্যাঁ আমি অহংকার করছি, এতোটা অহংকার আমাকেই মানায় কারণ প্রতি নিয়ত আমি একা একলা হেঁটেছি; একান্ত আপনজন বন্ধু পরিজন সবাই আমাকে ছেড়ে গেছে, তারপরও আমি জানি আমার চেয়ে বড় আপনজন তাদের আর কেউ নেই। আমার ভেতরের মানবিকতা আমায় শিখিয়েছে ভালো মেয়ে হবার চেয়ে ভালো মানুষ হওয়া অনেক জরুরি।

আজ আমি একজন ‘মা’, জীবন সঙ্গী হিসেবে পাশে পেয়েছি আমারি মতন একজনকে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আমার কন্যা। সেদিন ডাক্তার খুব সংকোচে আমায় জানিয়ে ছিলেন আমার মেয়ে হবে। যেন আমার গর্ভে মেয়ে হবার সমস্ত সংকোচ তার! উনার সংকোচকে আমি তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিয়ে ছিলাম বলেছিলাম, আমি গর্ববোধ করছি স্রোতের বিপরীতে হাঁটবার জন্য, আরেকজন মানুষকে পৃথিবীতে আনতে পারছি বলে।

আমার আনন্দ দেখে উনি আল্ট্রাসনোগ্রামে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেকগুলো ছবি তুলে দিয়েছিলেন আমার কন্যার। বলেছিলেন, নিন পৃথিবীতে আসার আগেই আপনার মেয়ের দৃঢ়-সুন্দর মুখ দেখে নিন। কন্যার বাবা আনন্দে দুই হাত ছড়িয়ে চিৎকার করছিল আমাদের মেয়ে হবে, আমাদের মেয়ে হবে, বলে। রাস্তার লোকজন দুই পাগলের আনন্দভরা মুখ খুবই বিরক্তির সাথে দেখছিল মেয়ে হওয়াতে এত আনন্দ কিসের!!! ওতো আর বংশের প্রদীপ জ্বালাতে পারবে না!! আচ্ছা বংশের প্রদীপ জ্বালানোর দায়িত্বটা ছেলেদের হাতে কে দিয়েছে বলুন তো…?

আমি ভীষণ খুশি এই ভেবে যে হাঁটতে হাঁটতে যখন আমি ক্লান্ত হয়ে যাবো ও আমার হাত ধরে বাকি পথটা নিয়ে যাবে।

ওর বংশের প্রদীপ জ্বালাবার কোন দায় নেই ও মানবিকতার মশাল জ্বালবে যে মশালের আলোতে নারীর প্রতি সকল বৈষম্য দূর হবে…… ।

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.