উপমা মাহবুব: দিনটা ছিল ৮ই মার্চ ২০১৬। সেদিন নারী দিবস উপলক্ষে হালকা বেগুনি রঙের একটা শাড়ি পরে অফিস গিয়েছিলাম। সাত বছর আগে বিয়ের দিন সকালে পারিবারিকভাবে আমার আকদ হয়েছিল। বরের বাড়ি থেকে দেয়া শাড়িগুলো থেকে বেছে বেছে খুব সাধারণ এই সিল্ক শাড়িটাই আমি গায়ে জড়িয়েছিলাম। বহু বছর পর সেই শাড়িটা পরে ব্র্যাক অফিসের বার তলায় আমার ছোট্ট সাজানো ডেস্কে বসে হঠাৎ চোখ পরল সহকর্মীর ডেস্কে ঝুলানো সৌখিন আয়নায়।

নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে সেই পুরনো আমাকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। নিজেকে সেই মেয়েটির সাথে মেলানোর চেষ্টা করলাম যে ছিল ইচ্ছাকৃতভাবে সাদাসিধে, মেয়েদের পুতুলের মতো মেকআপ আর সোনার গহনার চাকচিক্যের প্রতি যার কোন আকর্ষণ ছিল না, বিয়েতে অতিরিক্ত খরচ ও আয়োজনের যে ছিল প্রবল বিরোধী। কিন্তু অনেক ভেবেও নিশ্চিত হতে পারলাম না আমি এখনো সেই নারীবাদী, ভোগবিলাস আর বড়লোকি আচরণবিরোধী মেয়েটিই আছি, নাকি স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবনের স্বাদ পেতে শুরু করার পর আস্তে আস্তে অর্থবিত্ত, ভোগবিলাসের মোহে অন্য কোনো আমিতে পরিণত হচ্ছি।
আজকাল এই বিষয়টা মাঝেমাঝেই আমাকে ভাবায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় আমি যখন সমবয়সী বন্ধুর (বর্তমানে আমার স্বামী) সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যাই তখন কখনোই আমার মনে হয়নি যে এই ছেলের স্ট্যাবলিস হতে অনেক সময় লাগবে। আমি একধরনের ফ্যান্টাসিতে ভুগতাম। ভাবতাম যে আমরা দুজনই চাকরি করব। নিজেদের চেষ্টায় একটু একটু করে একদিন অনেক কিছু হবে।
বড়লোক বাবার পুত্র অথবা অনেক অর্থ উপার্জন করে এমন ছেলেকে বিয়ে করে একটা নিশ্চিন্ত জীবন নয়, বরং অনেক সংগ্রাম থাকবে, চ্যালেঞ্জ থাকবে সেই জীবনের আমি স্বপ্ন দেখতাম।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পর আরেক ফ্যান্টাসি আমাকে পেয়ে বসলো।
আমি ঘোষণা দিলাম দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে চাই, টাকা পয়সার আমার দরকার নাই। বেসরকারি সংস্থার কাজকে পেশা হিসেবে বেছে নিলাম। সবাই অনেক বোঝালো, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চারটি স্তরের তিনটিতেই প্রথম শ্রেণীতে পাশ করা একটি মেয়ে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াবে, গরীব মানুষদের সাথে উঠা বসা করবে, প্রবল গরমে মানববন্ধন করবে এটা মানা বেশ কঠিনই বটে।
তাদের মতে আমার হওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু আমি কোনভাবেই রাজি হলাম না। কেননা জীবনে যেদিন প্রথম আমার সামনে কেউ বলেছিল যে মেয়েদের জন্য শিক্ষকতা সবচেয়ে ভাল পেশা, ঠিক সেদিনই আমি ঠিক করেছিলাম আমি কোনদিনই শিক্ষক হবো না। এ রকমের অনেক ফ্যান্টাসিতে ভোগা মানুষ আমি! প্রথম সন্তানের আকিকা মানুষ কত ধুমধাম করে উদযাপন করে।
আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনে ঠিক করলাম পথশিশুদের একটা সেন্টারে গিয়ে রাস্তার বাচ্চাদের সাধ্য অনুযায়ী খাওয়াবো। মাদ্রাসায় থাকে যে এতিম শিশুরা তারাও মাঝেমধ্যে ভাল খাবার পায়, আহা, পথশিশুরা বড্ড অবহেলিত তাদের মুখে একটু ভাল খাবার তুলে দেয়ার মতো কেউই তো নেই!
এভাবে মাসের শেষে টাকা ফুরিয়ে যাওয়া সংসারে, অল্পভাড়ার রং উঠা, পলেস্তরা খসা বাসায় সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় করতে করতে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর। এখন আমরা দুজনেই মোটামোটি সম্মানজনক যে চাকরিগুলো করি তাতে মাসের শেষে কিছু টাকা জমানোর পরও নিজের ইচ্ছাপূরণ করার জন্য অবশিষ্ট থেকে যায়। এখন আমি মাসে দুই বা ততোধিকবার পার্লারে যাই। মাঝে মাঝে নবীন সহকর্মীদের উৎসাহে অপ্রয়োজনেই জামা, শাড়ি কিনি। আমার ব্যাগে পেটমোটা সাজগোজের ঝুলি শোভা পায়। অথচ কিছুদিন আগেও হালকা রঙের এক লিপস্টিকেই পেরিয়ে যেত সারা বছর। একদিন নিজে গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাবো এটা এই মূহুর্তে আমার অত্যন্ত প্রিয় একটা স্বপ্ন!
মাঝে মাঝে নিজের দিকে তাকিয়ে তাই সত্যিই চমকে উঠি। স্বচ্ছলতার স্বাদ কি আমার নিজস্বতাকে গ্রাস করে নিচ্ছে? আমি কি আস্তে আস্তে আমার মতাদর্শ থেকে সরে যাচ্ছি? অর্থ আর সম্মানজনক চাকরির শক্তি কি এতই বেশি? জানিনা। তবে এতটুকু বুঝি যে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নিজেকেই রাখতে হবে। আমার স্বকীয়তাকে ধরে রাখার দায়িত্ব আমারই। এটা নিয়েই আমি এখন নতুন ফ্যান্টাসির জাল বুনছি।
আমি আমার ক্যারিয়ারকে, পরিবারের সামাজিক অবস্থানকে অনেক উপরের অবস্থানে নিতে চাই। আর সেই অবস্থানে পৌঁছেও আমি একজন নারীবাদী এবং ভোগবিলাস ও বড়লোকি আচরণবিরোধী মানুষ হয়েই থাকতে চাই। বাহ্যিকভাবে অনেক পরিবর্তন হলেও আমার মনের গভীরে এখনো বাস করে পুরোনো এক আমি।
মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে পাওয়া আদর্শের শিক্ষা, বই-এর রাজ্যে বিচরণ করতে করতে শোষণ-বঞ্চনা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা আর দেশপ্রেমের সংস্কৃতির মধ্যে তিলেতিলে এই সত্ত্বা গড়ে উঠেছে। আশেপাশে প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া, শুধুমাত্র নিজের সুখের জন্য বাঁচা মানুষের ভিড়ে দিশেহারা আমি বারবার এই সত্ত্বাটিকে অনুভব করার, তার কথা মেনে চলার চেষ্টা করি।
কেননা প্রবল প্রতিযোগিতার এই বাজারে একনিষ্ঠ পরিশ্রম হয়তো আমাকে ধনসম্পদ, গাড়ি-বাড়ি সহ অনেক কিছুই দেবে। কিন্তু আদর্শ থেকে সরে গেলে নিজের সত্ত্বার কাছে আমি একজন পরাজিত মানুষই হয়ে থাকবো। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবিতে প্রতিনিয়ত একজন পথভ্রষ্ট মানুষকেই দেখতে পাবো যে বাহ্যিকভাবে পেয়েছে অনেক; কিন্তু হারিয়েছে তার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ- ‘নিজস্বতা’।
ম্যানেজার, গ্লোবাল অ্যাডভোকেসি, ব্র্যাক