শামীম রুনা: শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সার ১৯৬১ সালে পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠির কোপানলে পড়ে জেলে যান, সেখানে বসে তিনি লেখেন ‘সারেং বৌ’ উপন্যাসটি, এবং এই উপন্যাসের জন্য ১৯৬৩ সালে ‘আদমজী সাহিত্য পুরষ্কার’ পান।
আর ১৯৭৮ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক সরকারের শাসনামলে ‘সারেং বৌ’ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে আবদুল্লাহ্ আল মামুন তৈরি করেন বিখ্যাত ‘সারেং বৌ’ সিনেমা। কদম সারেং চরিত্রে ফারুক আর নবিতুন নাম ভূমিকায় কবরী অভিনয় করেন। এই ছবিতে আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‘ওরে নীল দরিয়া..’ গানটির জনপ্রিয়তা তো ইতিহাস হয়ে গেছে।
ছবিটি যখন মুক্তি পায় তখন আমি বেশ ছোট ছিলাম, তারপরও যতটুকু মনে পড়ে দল বেঁধে মা-খালা বা বড়ো বোন এবং তাদের বান্ধবীদের ছবিটি দেখবার জন্য সিনেমা হলে ছুটে যেতে দেখেছি। অনেকে ছবিটি অনেকবার করে দেখেছিলেন।
শহীদুল্লা কায়সার তাঁর এই উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেন সারেং বৌ তথা নবিতুনের সঙ্গে। নবিতুন অন্যান্য আর দশজন গ্রাম্য বধুদের মতো, যার স্বামী প্রবাসী, জাহাজের সারেং; দুই কী তিন বছর পর পর বাড়ি আসে। একবার কদম সারেং জেলে যায় এবং জেল থেকে বের হয়ে আবার জাহাজের কাজে ফেরত গেলে তার দেশে ফিরতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এই সময় কদম সারেং যে টাকা পাঠায়, তা গ্রামের প্রভাবশালী লুন্দর শেখ এবং পোষ্ট মাস্টারের যোগসাজশের কারণে নবিতুনের হাত এসে পৌঁছায় না। ফলে সন্তান নিয়ে প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে নবিতুন।
অল্প বয়সী নবিতুনের জন্য দারিদ্র্য থেকে উদ্ধারের হাতছানি হিসাবে লুন্দরের বালাখানার প্রলোভন আসে। প্রবাসী কদম সারেং বিদেশিনীর জাদুতে পড়ে ভুলে গেছে নবিতুনকে; সবাই বিভিন্ন শংকার কথা বলে, কিন্তু নবিতুন কদমের ভালোবাসার প্রতি থাকে আস্থাশীল। রাতের অন্ধকারে যখন ঘরের বেড়ায় অশ্লীল আঁচড়ের শব্দ উঠে, ছেনি হাতে সাহসী নবিতুন দরজার আগল খুলে আক্রমণে উদ্ধত হয়।
প্রতিনিয়ত কুটনীর কুমন্ত্রণার সঙ্গে, ক্ষুধার সঙ্গে, দারিদ্র্যের সঙ্গে, অনিশ্চয়তা আর প্রলোভনের সঙ্গে যুদ্ধ করে তবুও টিকে থাকে নবিতুন। গ্রামের নির্জন অন্ধকার পথে লুন্দর যখন নবিতুনকে পাট ক্ষেতে নিয়ে লালসার শিকারে পরিণত করতে চায়, তখনও সে সাহস বা উপস্থিত বুদ্ধি কোনোটাই হারায় না। জ্বলে উঠে স্ফুলিঙ্গের মতো, সে আগুনের কাছে পরাজিত লুন্দর মার খাওয়া পশুর মতো পালিয়ে যায়।
উপন্যাসের নাম যেমন ‘সারেং বৌ’ তেমনি পুরো উপন্যাসের পটভূমি জুড়ে সারেং বৌ তথা নবিতুনের সাহস, ধৈর্য্য, সংগ্রাম, মমতা, ভালবাসা আর মানবতা বোধের কাহিনীই বারংবার বর্ণিত হয়েছে। নবিতুন প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ভেবেছিল গুঁজাবুড়ির মুখে কচুবাটা পুরে দেবে, কিন্তু গুঁজাবুড়ি যখন ওর কাছে একটু পান্তা চায় তখন সে নিজের ভাগের পান্তাটুকু গুঁজাবুড়িকে দিতে সামান্য কার্পণ্য করে না।

নবিতুনের জীবনীশক্তি আর মানবতা বোধের প্রবল বিস্ফোরণ আমরা দেখি উপন্যাসের একেবারে শেষে এসে, উপকূলের জলোচ্ছ্বাসে, গোর্কিতে ঘরবাড়ি, গাছপালা সবকিছু ভেসে গেছে, শূন্য পলি পড়া চর; কদম সারেং তার যে শালতি শালতি বাহু নিয়ে দুনিয়ার তাবৎ সাগর সাঁতরে বেড়িয়েছে, সেও যখন পা টলে পড়ে যায়, তখনও ‘মেয়েটি কিন্তু শক্ত। খুব বেশি টলছে না ও। পা’টা ওর আস্তে-আস্তে উঠছে আর পড়ছে, একটুবা কাঁপছে। কিন্তু কী নিশ্চিত তার পদক্ষেপ’।
এভাবেই নবিতুনকে নতুন পৃথিবীতে আবার জেগে উঠতে দেখে পাঠক। সে মুমূর্ষু কদম সারেং-এর তৃষ্ণা যখন সমুদ্রের লবন পানি দিয়ে মেটাতে পারেনা, তখন নবিতুন সকল ধর্মীয়, সামাজিক বিধি-নিষেধের উপর উঠে মানবতাকে একমাত্র ধর্ম মেনে প্রবল মাতৃত্বের আধার হয়ে ওঠে। সদ্য মৃত সন্তান জন্ম দেবার কারণে ওর বুকে জীবনের যে স্পন্দন সুপ্ত ছিল তা সে স্বামীর মুখে গুঁজে দেয়। কোনো সংস্কারই তাকে তখন রুধতে পারেনি। পরম মমতায় চেয়ে চেয়ে দেখেছে কদমের মুখে পুনরায় ফুটে ওঠা প্রাণের আভাস।
ত্বকের অন্তরালে রক্ত চলাচলের ক্ষীণ দ্যুতি দেখে আনন্দে, বিস্ময়ে, সঞ্জীবনী জীবনধারার অসহ্য আবেগে নবিতুন কেঁপে উঠেছে বারবার। নবিতুনের কাছে কদমের জীবনটাই ছিল সবচেয়ে বড়ো। তাই তো সব সংস্কারকে বুড়া আঙুল দেখিয়ে কদমকে বাঁচিয়েই সে বিজয়িনী। এভাবেই নবিতুন হয়ে উঠেছে নারীত্ব, মাতৃত্বের আর মানবতার চিরন্তন প্রতীক।
পঞ্চান্ন বছর আগে শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সার পরাধীনতার কোলে চড়ে, ধর্মীয় বিধি-নিষেধের ঊর্দ্ধে উঠে; মানবতাকে মুখ্য করে মানুষের বেঁচে থাকার উপন্যাস লিখে গেছেন। তাঁর উত্তরসুরী হয়েও বর্তমান প্রজন্ম তাঁর মতো সে সাহস বা স্পর্ধা নিয়ে লিখতে পারছে না। বর্তমান সময় বারবার লেখকের লেখাকে নানা ভাবে শৃঙ্খলিত করে তুলছে। মানবতার চেয়ে ধর্মীয়, সামাজিক বা অন্য কোনো বিধি-নিষেধ লেখা বা মত প্রকাশের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ, শিল্প সাহিত্যে আমাদের আরো বহুদূর যাওয়ার কথা ছিল। আমরা সে সময়ের প্রতীক্ষায়, যেদিন আরেক গোর্কির পর; মানবতার নতুন পলির চরে; আরেক নবিতুনের সাহসী হাত ধরে আমাদের লেখা আরো মানবিক হয়ে ওঠবে এবং মানবতার পথ ধরে এগিয়ে যাবে।
বর্তমান সময়ে, বিশেষ করে নারীরা এক বিশাল অনিশ্চিত সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নারীরা নারীদের নিজস্ব রুচি-ভাবনার স্বকীয়তা হারাতে চলেছে, নিজেদের স্বাধীনতা হারাতে চলেছে।
যদিও নারীরা কখনই স্বাধীন ছিল না বা নেই বলেই অনুভব করি। তারপরও এই একবিংশ শতকে নারীর পোশাক বা নারীর করণীয় নিয়েও যখন ধর্ম বা সমাজের দোহাই দিয়ে রক্তচক্ষু শাসাতে আসে তখন নারীর নিজের অস্থিত্ব রক্ষার জন্যে হলেও রুখে দাঁড়াতে হয় নারীকে। এই রুখে দাঁড়ানোর সাহসটুকুর জন্য নারী অনুকরণীয় খুঁজতে বহুদূর নাইবা গেলো, নবিতুনের সাথেই চলুক আর মানবতা ধর্মেই থাকুক নারী। সকল কুসংস্কার আর প্রাচীন প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের পথে এগিয়ে চলুক। জয় হোক সকল নারী স্বাধীনতার!