ক্রিটিক্যাল থিংকিং বনাম নেগেটিভিটি -২

শাশ্বতী বিপ্লব: কোন কোন গান মনটাকে কেমন ভিজিয়ে দিয়ে যায়, শৈশবের ঘ্রাণে ভরে ওঠে বুকের ভেতরটা। গলার কাছটায় ব্যাথাটা ঘুরাঘুরি করে। “ও তোতা পাখীরে, শিকল খুলে উড়িয়ে দেবো, মাকে যদি এনে দাও।” অথবা, “বাবা কতদিন কতদিন দেখিনা তোমায়, কেউ বলেনা তোমার মত, কোথায় খোকা ওরে বুকে আয়।” এই হাহাকারগুলো সব না ফেরার দেশে চলে যাওয়া বাবা মাকে নিয়ে।

Shaswati 4মা-বাবা না থাকার কষ্ট কতটা সেটা যার নেই সেই কেবল জানে; ভিতরে একটা অংশ খালি হয়ে যায় চিরদিনের জন্য। কিন্তু বেঁচে থাকা বাবা মা প্রায়ই আমাদের প্রায়োরিটি লিস্টে জায়গা পান না, কেনো যে!!!

বাবা-মাকে নিয়ে আমাদের সামাজিক আবেগের ঘাটতি নেই, ঘাটতি নেই গোপন অবহেলারও। ভুল বলছি না একরত্তিও, বাড়িয়েও বলছি না। প্রবীণদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, গুটিকয় ব্যতিক্রম ছাড়া এটাই আমাদের বাস্তবতা। একটি কি দুটি সন্তান নিয়ে এইতো আমাদের ছোট পরিবার – সন্তানের লেখাপড়া, একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত করা, ব্যবসা বা চাকরির ক্যারিয়ার, সোশ্যাল লাইফ, বন্ধু, আড্ডা, ঘুরতে যাওয়া – এসব মিলিয়ে আমরা ভীষণ ব্যস্ত; আমাদের সময় কই পরিবারে প্রবীণ মানুষটির জন্য?

অনেকে হয়তো মনে মনে অপরাধবোধেও ভুগি, কিন্তু সেটা আর বাস্তবায়ন করা হয়ে ওঠে না। অথচ তাঁদের জীবনটা খরচ হয়ে গেলো আমাদেরকে জীবন উপভোগ করার মতো লায়েক বানাতে গিয়ে।

আমরা বাইরের অন্যায়ের খুব প্রতিবাদ করি আর নিজের ঘরের ভিতর অন্যায়কে পুষে রাখি। কিছু পরিসংখ্যান বলি: বাংলাদেশে ৮৮% প্রবীণ মানসিক নির্যাতন, ৮৩% অবহেলা, ৫৪% অর্থনৈতিক এবং ৪০% শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। এই ৪০ শতাংশের ৫৪ ভাগ নারী এবং ৪৫ ভাগ পুরুষ।

8 March 3যদিও পরিসংখ্যান সবটা বলতে পারে না। এই সংখ্যার পিছনে লুকিয়ে থাকে কদর্য, নিষ্ঠুর সব গল্প। মানতে কষ্ট হয়, তবুও এটা রুঢ় সত্য। গরীবের গল্পটা তবু জানা যায়, বোঝা যায়; কিছু টাকা পয়সা দিয়ে চ্যারিটি করার সুযোগও পাওয়া যায়। কিন্তু জানা যায় না মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্পগুলো। সংসারে শত অবহেলা, নির্যাতন মুখ বুজে সয়ে যান মধ্যবিত্ত ঘরের প্রবীণ বাবা-মা; তথাকথিত “সোশ্যাল প্রেস্টিজ” বা সম্মানহানির ভয়ে। নিজের সন্তানের ঘরে নিগৃহিত হওয়ার লজ্জা তাঁরা ঢেকে রাখেন সযতনে।

একটি শিক্ষিত, ভদ্র (!) পরিবারকে জানি, যেখানে ৮০+ বয়সী এক মা মানবেতর জীবন কাটান। গালিগালাজ, খাওয়া-পরার খোঁটাতো আছেই, বেশি বিরক্ত হলে তাকে মারধোরও করা হয়। স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানদের মধ্যে ঠেলাঠেলির পরে তাঁর জায়গা হয়েছে বড় ছেলের সংসারে। দুটো নাতনীও আছে। ভাববেন না কেবল ছেলের বউ তাঁকে মারধোর করে, ছেলে নিজেও মাকে মারতে পিছপা হয় না। খারাপ ব্যবহার করে নাতনী দুইটাও। যদিও সামাজিক পরিমণ্ডলে এরা সবাই সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। গল্প, কবিতা লেখে, গান করে!!!

আরেকটি ভদ্র (!) পরিবার বাসায় কোন অতিথি আসলে বা কোন পার্টি থাকলে বৃদ্ধ বাবাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে স্টোর রুমে আটকে রাখে। নইলে তিনি চেয়ারের হুইল ঘুরিয়ে অতিথিদের মাঝে চলে যান। ছেলেমেয়েরা বিব্রত বোধ করে!!

এর উল্টোপিঠে আছে আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য নিয়ে অহংকার ও বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে একধরনের নেতিবাচক মনোভাব। কারণ সন্তান হিসেবে আমাদেরও সামাজিক সম্মান হারানোর ভয় কম নয়। পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যটির প্রতি আমরা যতই নিষ্ঠুর হইনা কেন, আমার সংসারে বৃদ্ধ বাবা মায়ের জায়গা হয়নি সেটা আমরা কোনভাবেই প্রতিষ্ঠা করতে চাইনা।

২০০৯ থেকে ২০১৩ সময়কালে হেল্পএইজ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করার সুবাদে এরকম অনেক কদর্য গল্প জানার সুযোগ হয় আমার। আমার কাজের একটা বড় অংশ ছিলো প্রবীণদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা ও বৃদ্ধাশ্রমকে নিরুৎসাহিত করা; উপযুক্ত আইনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো। কাজও হয়েছে কিছু, যেমন সরকার অভিভাবকদের জন্য ভরণপোষণ আইন করেছে ২০১৩ সালে। কিন্তু আইন দিয়ে কি আর ভালোবাসা আদায় করা যায়!!

সেসময় নারী নির্যাতনবিরোধী একটি প্লাটফর্মের সাথে যৌথ উদ্যোগে প্রবীণ নারীদের নিয়ে এক গবেষণার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। গবেষণার প্রস্তাবনা লেখার পর ফিডব্যাক পেলাম, সংসারে প্রবীণদের সেবার দায়িত্ব যেহেতু প্রধানত নারীর ঘাড়ে এসে বর্তায়, সেহেতু সেই নারীর কথাও ভাবতে হবে। বিশেষ করে, কর্মজীবী নারী যখন এমনিতেই ঘর-বাহির সামলাতে জেরবার তখন তার উপর আরেকটা দায়িত্ব চাপানোর কথা সুপারিশ করার আগে ভাবা দরকার। ন্যায্য কথা, বেশিরভাগ সংসারের পুরুষটিতো এই দায়িত্ব ভাগ করে নেয় না। আমার মাথায় গিট্টু পাঁকিয়ে গেলো, গবেষণার কাজটা আর এগোলো না।

শাশুড়ী না থাকা নিয়ে আমি প্রায়ই আক্ষেপ করি। তার বিপরীতে আমাকে অনেকবার শুনতে হয়েছে, আমি বেঁচে গেছি। যারা বলেন তারা তাদের অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো বলেন। কিন্তু বউ-শাশুড়ীর বনিবনা নিয়ে এই নেতিবাচক ধারণাও প্রবীণ অভিভাবকদের পরিবারে রাখাকে নিরুৎসাহিত করে। চারদিকে যা দেখেছি, দেখছি, তাতে আমি বেঁচে গেলাম না আমার শাশুড়ীই আমার হাত থেকে বেঁচে গেলেন তা হলফ করে বলতে পারি না।

বছর ঘুরে ফিরে ফিরে আসে বাবা দিবস, মা দিবস; আর ফেসবুকে শুভেচ্ছার পাশাপাশি প্রতিবাদেরও ঢল নামে। যারা বিরোধিতা করেন, তাদের দাবি, বাবা-মাকে দিবস গুনে ভালোবাসার কি আছে? বাবা মাকে তো সারাবছরই ভালোবাসি। সত্যিই বাসিতো? যেসব বাবা-মায়ের সন্তানের পরিবারে সসম্মানে জায়গা হলো, তাঁরা সৌভাগ্যবান (!)।

কিন্তু যাদের জায়গা হলো না বা দায়সারা ভাবে হলো; যারা শুধু যাওয়ার জায়গা নেই বলে মুখ গুজে কোনরকমে পড়ে রইলেন, বেঁচে থেকেও প্রতিদিন মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেন – তাদের জন্য কি বৃদ্ধাশ্রমই ভালো নয়? অন্ততঃ নিজের সন্তানের হাতে, আপনজনের হাতে নিগৃহিত হওয়ার অপমান, দুঃখ তো থাকে না সেখানে!!

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.