ঈশ্বর ফিরিয়া গেলেন

শাশ্বতী বিপ্লব: ইত্যবসরে মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের একচোট ঝগড়া হইয়া গেলো। সৃষ্টিকর্তা বিষণ্ন বোধ করিতে লাগিলেন। তাঁহার আপন সৃষ্টি কেমন করিয়া এমন অবাধ্য হইতে পারে তিনি বুঝিয়া পাইলেন না।

ঈশ্বর সৃষ্টির আনন্দে বিমোহিত ছিলেন – শত সহস্র ছায়াপথ, অযুত, নিযুত নক্ষত্রপুঞ্জ ও গ্রহাণু তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন এবং করিয়া চলিয়াছেন। তাহাদের মাঝে কত রকমের প্রাণবৈচিত্র্য তিনি সৃষ্টি করিয়াছেন।কিন্তু তাহাদের একত্রিত হইবার ব্যবস্থা রাখেন নাই। নিজ নিজ বৈচিত্র্য লইয়া তাহারা বাঁচুক, ইহাই তাঁহার ইচ্ছা।

এরই মাঝে পৃথিবী নামক একখানি ছোট্ট গ্রহ হইতে মানুষ নামক প্রাণের আর্তচিৎকারে তাঁহার কাজে ব্যাঘাত ঘটিল।তিনি আসিতে বাধ্য হইলেন। দেখিলেন, বিরাট অরাজকতা চলিতেছে, কাহারো সাথে কাহারো সদ্ভাব নাই, তাহারা দলে দলে বিভক্ত। কেহ কাহারে মানে না, কেবল নিজের স্বার্থ খুঁজিয়া বেড়ায়।

তিনি দলাদলির ক্যাঁচালে পড়িয়া গেলেন। একদল আরেক দলকে মারিতেছে – যাহারা মরিতেছে তাহারাও ঈশ্বরকে ডাকিতেছে, যাহারা মারিতেছে তাহারাও তাঁর নাম লইয়া মারিতেছে। কেহ ইশ্বরের নাম লইয়া মতলববাজি করিতেছে তো, কেহ আবার সেই মতলববাজির বিরুদ্ধাচারণ করিতে গিয়া আরেক মতলব ভাজিতেছে।

এই ছোট প্রাণগুলো ধর্ম বলিয়া এক রীতি চালু করিয়াছে। ইহারা কেহ মন্ত্র পড়ে, কেহ আজান দেয়, কেহ ক্রুশ আঁকে, কেহ তাঁহার প্রতিমূর্তি বানায়, কেহ ঈশ্বরের নামে গান করে তো, কেহ গৃহত্যাগী হয়। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়িয়া তাঁহার সৃষ্ট শত শত ছায়াপথের অযুত নিযুত প্রাণেরা আরো কত নানা রঙে, নানা ঢঙে তাহাকে স্মরণ করে, সকলই তিনি উপভোগ করেন। কেহ কেহ আবার এসবের ধারই ধারে না, তাদেরও তিনি মায়াভরে দেখেন। সকলই যে তাঁহার সৃষ্টি, তিনি সকলকে ভালোবাসেন।

Shaswati 4কিন্তু আজ তিনি পৃথিবীতে আসিয়া বিষম বিপদে পড়িয়াছেন, কেহ তাঁহাকে চিনিতে পারিতেছে না। তিনি প্রথমে যাহারা মারিতে উদ্যত তাহাদের নিবৃত করিবার চেষ্টা করিলেন, পারিলেন না। তাহারা ঈশ্বরকে অপরপক্ষের এজেন্ট মনে করিয়া দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিলো। কেহ বলিল, নিজের প্রাণখানি লইয়া পালাও এইবার। নইলে তুমিও মরিবে।

তিনি অপর দলের কাছে যাইতেই তাহারা ভয় আর অবিশ্বাসের চোখে তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল। কেহ আবার তাহার মতলবখানা বুঝিবার চেষ্টা করিল। একজন বৃদ্ধা সাহস করিয়া বলিলো, “তুমি কোন দলেরগো বাছা? বিশ্বাস করো আমরা তোমাদের লইয়া কোনরূপ বিদ্রুপ করি নাই। আমাদের তোমরা ছাড়িয়া দাও। আমরা চলিয়া যাইবো।”

ঈশ্বর অসহায় বোধ করিলেন। তিনি রাগ করিলেন, নরম গলায় বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোন কাজ হইলো না। কেহ তাঁহার কথা শুনিলো না। শেষতক সকলে তাঁহাকে পাগল ভাবিয়া, গালাগাল করিয়া, ঢিল ছুঁড়িয়া খেদাইয়া দিলো।

তিনি একবার ভাবিলেন এক্ষুণি সকলকে উচিত শিক্ষা দেন, এক নিমেষে ধ্বংস করিয়া দেন গ্রহটিকে। কিন্তু নিজের সৃষ্টি নিজে ধ্বংস করিতে তাঁহার বাঁধিল। তিনি পৃথিবী নামক গ্রহটিকে চিরতরে পরিত্যাগ করিলেন। তিনি বুঝিলেন, এরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডাকিয়া আনিবে, তাহার কষ্ট করিবার দরকার নাই।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.