রাষ্ট্রধর্মের আগ্রাসনে কে কোথায় ছিটকে পড়ি কে জানে!

শামীম রুনা: আমাদের দেশে আমাদের সমাজে ধর্ম সবসময়ই ছিল। আবার সম্প্রীতিও ছিল। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি সব ধর্মের মানুষ পাশাপাশি বাস করে যে যার ধর্ম পালন করতো এবং একে অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ছিল আমন্ত্রিত অতিথি।

Religion and Politicsআমি আমাদের ঈদে সব সময় দেখেছি বাসায় মুরগী বা খাসীর মাংস রান্না হতো শুধু আপাদের আর দাদার বন্ধুরা আসবে বলে। আম্মার প্রিয় সখী, লুডু খেলার পার্টনার মাসী যখন পূজা করতেন তাঁর পিছনে হাভাতের মতো বসে থেকেছি প্রসাদের লোভে। মাসীও পূজা শেষে আমাদের হাতে হাসি মুখে প্রসাদ তুলে দিতেন, সে মিষ্টি হোক, কী সামান্য চিনির ঢেলাই হোক।

পরীক্ষার ভাল রেজাল্টের আশায় তো আর কম ব্রতের-ভাত খাওয়া হয় নাই। আমার গল্প শোনার ভিত তৈরী করে দিয়েছিলেন মাসীর ছেলে জড়ুদা, মহাভারত শুনিয়ে শুনিয়ে।প্রিয় শিক্ষক বরিশাল হালিমা খাতুন গার্লস স্কুলের গণপতি স্যার, আমার শিক্ষার অনেকটাই এই স্যারের হাতে। স্যার যদি প্রতিদিন গাইড বই দিয়ে মাথায় একটা করে গাট্টা না মারতেন, তাহলে আমার এসএসসি পাশ কঠিন হতো, ধর্মেও হয়ত লেটার মার্ক জুটতো না।

স্যার ছিলেন বড়পা’র রান্নার ভক্ত,আমাদের বাসার যেকোন অনুষ্ঠানের অতিথি। এছাড়া পার্বত্য উপজেলায় ছোটবেলায় বাস করবার জন্য অনেক আদিবাসী পরিবারের সাথেও ছিল আমাদের পরিবারের বন্ধুত্ব। সে কারণে ফানুস উড়ানো থেকে কঠিন চিবর দান, জন্ম মৃত্যুর ক্রিয়াকলাপ, বড়দিন থেকে মাঘী পূর্ণিমা সব ধর্মীয় অনুষ্ঠান সবার জন্য ছিল উন্মুক্ত। সে সময় আমাদের বছরের বারো মাসই কাটতো কোনো না কোনো উৎসবে।
তখন ধর্ম আমাদের মধ্যে কোনো বিভাজন তৈরি করতে পারেনি, অথচ আজ কেন সেই ধর্মই একচক্ষু রাক্ষুসীর মতো আমাদের দিকে চাপাতি হাতে ছুটে আসছে! আমরা কি দিন দিন সভ্য হচ্ছি, না আরও বর্বর?        
স্বাধীনতার পর আমাদের কোনো রাষ্ট্র ধর্ম ছিল না। আমাদের স্বৈরাচারী শাসক নিজের কিছু অপকর্ম ঢাকার জন্য রাষ্ট্র ধর্ম প্রবর্তন করলেন। এতে ধার্মিকরা খুশি হলেন। তিনি রবিবারের বদলে শুক্রবারে সাপ্তাহিক বন্ধ ঘোষণা করলেন, মুসল্লিরা আরও সন্তুষ্ট হলেন। তারপর তিনি বহুপত্নী এবং উপপত্নীর রেওয়াজ চালু রাখলেন, হুজুররা লোভী হয়ে স্বৈরাচার শাসকের জন্য দোয়া করলেন।

বিভিন্ন অপকর্ম ঢাকার জন্য রাষ্ট্র ধর্মকে ঢাল বানানো হলে দেশের সাধারণ ম্যাঙ্গোম্যানরা ভেবেছিল, দেশে স্বপ্নের গণতন্ত্র এলে দেশ থেকে এই রাষ্ট্রীয় ধর্ম বিলুপ্ত হবে। কিন্তু আমাদের সাধের ‘গণতন্ত্র’ (?) এলেও ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’ নীতি অবলম্বন করে আমাদের দুই নেত্রীর একজন পরলেন এক্সট্রা দোপাট্টা, আর একজন পরলেন হিজাব। তাঁরা দুইজন সকল বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করলেও ধর্মের বিষয়ে তাঁরা একমত, এবং রাষ্ট্র ধর্মের বিষয়ে চুপ করে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।

Runa collageমাথার উপর রাষ্ট্র ধর্মের বর্ম নিয়ে দেশে অনেক অধার্মিক কাজ অতীতেও হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে, সেসব বাদ দিলেও নতুন করে রাষ্ট্র ধর্মকে আবার রাষ্ট্র ধর্ম বানাতে যেয়ে আবারও কিছু মানুষকে ঘরহারা হতে হলো। আবারও কিছু মানুষ লাঞ্ছিত হলো, কিছু নারী নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হলো এবং হচ্ছেও। বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মানুষরা আবারও বুঝলো, আল্লাহ, দেবতা, ঈশ্বর বলে কিছুই নাই। থাকলেও তাঁরা হয়তো কানা-বয়রা-বোবা। হয়তো লেংড়া-লুলাও। তা নাহলে এতো অধর্ম দেখেও তাঁদের ধর্মের কল একটুও নড়ে না কেন?

তাই এখন আমাদের মতো মানুষের কাছে রাষ্ট্র ধর্ম মানেই, মানুষ মানুষের গলায় ছুরি চালাবে, আগুন জ্বালাবে।পরের বাড়ি, পরের নারী, পরের জীবন হরণ করবে। অথচ ধর্মই নাকি বলছে, কোনো সম্পদই কেউ সাথে নিতে পারবে না। সকলই মায়ার পৃথিবীতে রেখে যেতে হবে। তাহলে এতো সম্পদ নিয়ে এই ধার্মিকরা কী করবেন? কিছুই তো কবরে নিয়ে যেতে পারবেনা!
এই সব কথাও বাদ দিলাম।

এখন রাষ্ট্র ধর্ম পেয়ে এই ধার্মিকদের, হুজুরদের নোলা কিন্তু ভালোই বেড়েছে। ওরা গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দশ দফা দাবির আব্দার করেছে। করতেই পারে, সরকার তো এদের কাছে জিম্মি, দেশে ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে চাপাতি দিয়ে কোপালে সরকারের সূক্ষ্ম অনুভূতিতে আঘাত লাগে না, নারীদের দেখে হুজুরদের লালায় দেশ ভেসে গেলেও সরকারের অনুভূতিতে আঘাত লাগে না- ওরা বুঝে গেছে সরকার বাহাদুর ওদের পক্ষে, সুতরাং দাবি করাই যেতে পারে।  

প্রথম দাবি, রাষ্ট্র ধর্মের দেশে কোনো বিধার্মিক প্রতিষ্ঠান থাকতে পারবে না, শুধু রাষ্ট্র ধর্মের প্রতিষ্ঠান থাকবে। বুঝাই যাচ্ছে কয়দিন পর বলবে, কোনো বিধার্মিকও এদেশে থাকতে পারবে না, খালি ধার্মিক মুসলমানরা থাকবে। রাষ্ট্রীয় ধর্মের সকল ‘জশনে জুলুস’ অনুষ্ঠান রাষ্ট্রীয় খরচায় হবে। আহা! রাস্তা বন্ধ করে সারা রাত হুরদের সাথে জলকেলী করার কাল্পনিক গল্প শোনা! হিন্দু মন্ত্রীর পদত্যাগসহ আরো কিছু দাবি।
মোদ্দা কথাটা হলো,পুরা দেশটার ঘর সংসার মাটি করবার জন্য রাষ্ট্র ধর্ম হা করে এগিয়ে আসছে। আগে সামরিক শাসকের আমলে প্রবর্তিত রাষ্ট্রধর্ম এখন সো-কলড গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এসে মহা আড়ম্বরে বৈধতা পেল, এখন আর ঠেকায় কে!

আগে ধর্ম একপা গিয়ে দুই পা টললেও এখন কিন্তু আর টলছে না। এখন সে, ‘হাঁটি হাঁটি পা পা করে সর্বগ্রাসী হয়ে এগোচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, রাষ্ট্র ধর্মের এই আগ্রাসন আমাদের কোন নরকে নিয়ে ফেলে।

শেয়ার করুন: