রাষ্ট্রের ধর্ম আবশ্যক কেন?

তানিয়া মোর্শেদ: রাষ্ট্র কি কোনো মানুষ? একমাত্র মানুষেরই ধর্ম থাকে। কারণ মানুষই ধর্ম তৈরি করেছে। নিজের প্রয়োজনে তৈরি করেছিল। বেশ কিছু মানুষ এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না আর। একটি রাষ্ট্রে্র নাগরিক ধর্ম বিশ্বাসী, পালনকারী এবং অবিশ্বাসী সব ধরনের হতে পারেন।

আবার ধর্মও অনেক। তাহলে রাষ্ট্র কিভাবে একটি ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম বানায়? আর কেনই বা বানায়? আর যে রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে রাষ্ট্রধর্ম ছিল না সেই রাষ্ট্র কীভাবে বর্তমান যুগে ধর্মের আশ্র্য় খোঁজে? ধর্ম একটি আশ্রয়। কারো দরকার হয়, কারো হয় না। কিন্তু রাষ্ট্রের কিসের দরকার ধর্মের আশ্রয়ের? বাংলাদেশ কি সত্যিই ইসলামের আশ্রয়হীন ছিল সেভাবে কখনো? থাকলেও তা কতদিন পর্যন্ত ছিল?

ধর্মকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের জন্ম। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের খুব কম সময়েই ভুল ভেঙ্গেছিল। তাহলে সেই দেশের (বাংলাদেশের) জন্মের শুরুর দিকেই কি ইসলামকে (ধর্মকে) রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হতো না? যে দেশ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃস্টান, অন্যান্য আরো কিছু ধর্মের মানুষের, সেই রাষ্ট্রে শিক্ষা ব্যবস্থায় কেন ধর্ম থাকবে? কেন মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে? শুরুতেই কি “শিক্ষা সবার জন্য এক” এই শিক্ষা ব্যবস্থা করতে হতো না? ধর্ম, ধর্ম শিক্ষা ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখতে হতো না?

যে দেশের শিক্ষার হার এতো কম, ১৯৭১-এ এবং তারপরেও অনেক কম ছিল, সেদেশে ধর্ম শিক্ষাকে শুরুতেই রাষ্ট্র থেকে আলাদা করতে হতো। অশিক্ষিত মানুষকে সহজে মগজ ধোলাই করা যায়। আর ধর্মের আফিম খাওয়ানো আরো সহজ। পাকিস্তানিরা যদি মুসলমান না হতো, তাহলে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) একটিও রাজাকার থাকতো না। বাংলাদেশে রাজাকার বিষয়টি তো ইসলাম ধর্মের কারণেই। তাহলে কেন দেশের জন্ম লগ্নেই ইসলামকে (ধর্মকে) রাষ্ট্রের সব কিছু থেকে আলাদা রাখা হলো না?

71 war 5শিক্ষার আলো একটি জাতিকে অনেক দূর নিয়ে যায়। আর ঠিক উল্টোদিকে নিয়ে যায় ধর্ম শিক্ষার অন্ধকার দিক। বাংলাদেশ তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। যে আফগানিস্তান, ইরান এক সময়ে এতো অগ্রসর ছিল, ষাটের দশকে নারীর অবস্থান বিবেচনা করলেই বোঝা যায়, সেই দেশ ধর্মকে আঁকড়ে আজ কোথায় নেমেছে! বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় সুযোগ হারিয়েছে শুরুতেই। শুরুতেই ধর্মীয় শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করতে হতো। তাহলে রাজাকার, পাকিস্তানপন্থী মানুষ, জামাত, শিবির ধর্মকে ব্যবহার করে গ্রামের অশিক্ষিত মানুষদের দলে টানতে পারতো না। জন্ম হতো না ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের।

আর ৭৫ পরবর্তী সময় তো হচ্ছে সম্পূর্ণ ভাবে পেছনের দিকে হাঁটা। ধর্মকে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা। ষাটের দশকে যতোজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন, তা স্বাধীন দেশে না বেড়ে উল্টো কমতে শুরু করেছে!

সংবিধানে পরিবর্তন এনে ২৮ বছর আগে সামরিক শাসক এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন। এই ২৮ বছরে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত মুসলমান আরো ধার্মিক হয়েছে। এমনকি নাস্তিক মানুষের সন্তান ধার্মিক হয়েছে! অল্প শিক্ষিত নারীর উচ্চশিক্ষিত কন্যা হিজাব, বোরখা ধরেছেন! এই নারীর মা, নানী, দাদী কোনোদিন বোরখা ধরেও দেখেননি। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত নারীই যদি ওহাবিজমের শিকার হোন, তাহলে গ্রামের অশিক্ষিত, দরিদ্র নারীর কী হবে?

Tania Lopa
তানিয়া মোর্শেদ

একটি সমাজ, রাষ্ট্র কোন দিকে হাঁটছে তা বোঝার সবচেয়ে বড় উপায় সেই সমাজের, রাষ্ট্রের নারী এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুর অবস্থান। এই সংখ্যালঘু হচ্ছে তারা, যাদের কোনো কন্ঠ নেই। কেউ কেউ আবার সংখ্যালঘু বলতে কেবল সংখ্যা বোঝেন। এবং কোনো কোনো রাষ্ট্রে সংখ্যায় কম মানুষ ক্ষমতায় থাকেন, থাকতে পারেন, যেমন পাকিস্তানে ছিল শাসকেরা। উপনিবেশে ছিল শাসকেরা।

ফিরে আসি মূল কথায়। গত ২৮ বছরে বাংগালী মুসলমান আরো বেশী করে মুসলমান হয়েছে। আর ভোটের রাজনীতির কারণে নেতারা সবাই মুসলমানের মন জুগিয়ে চলেছেন! দেশ প্রতিদিন আরো সাম্প্রদায়িক হয়েছে, হচ্ছে। এ অবস্থায় সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দিলেই এই চরম সাম্প্রদায়িক মানুষগুলো অসাম্প্রদায়িক হয়ে যাবে না। সাম্প্রদায়িকতা এদের মগজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকেছে। বাংলাদেশকে হাঁটতে হবে অনেক দূর। ধর্মকে, ইসলামকে যতোদিন না একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে আসা না যাবে ততদিন বন্ধ হবে না অন্ধকারে পথ চলা। আর নিয়ে আসবে কে? ভোটের হিসাব করা কোন দল, কেউ?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.