সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: আমি প্রাণপন চেষ্টা করে চলছি আমার হাতদু’টি উঠাতে। একটুও নড়াতে পারছিনা। যেন পাহাড়ের সমান ভার নিয়ে হাতদু’টি পড়ে আছে আমারই পাশে। চেষ্টা করতে করতে আর চেষ্টা করার চেষ্টাও করতে পারছি না। বুঝতে পারছি চেষ্টাটুকুও আমার একটু একটু করে অচেতনে চলে যাচ্ছে। চারদিক ঝাপসা হতে হতে দেখতে পাচ্ছি আমার দিকে একটি ছায়ার এগিয়ে আসা।
‘দেখো, দেখো, চোখ খুলে দেখো, সুবিশাল সমুদ্রের বুকে যেন নেমে এসেছে ভরা পূর্ণিমার মতো গর্ভবতী চাঁদ। স্নিগ্ধ ভরাট চাঁদটি থেকে বাঁধনহীন ঝর্ণার মতো কেমন জ্যোৎস্না উপছে পড়েছে নিচে। সমু্দ্রের রাশি রাশি ঢেউয়ে কোটি চাঁদের প্রতিবিম্ব হয়ে জোয়ারে ভাসছে শাদা আলো। দাপুটে শীতল বাতাস বেলাভূমি তীরের সারি সারি গাছগুলোর পাতায় তুলছে শনশন সুর। দেখো, মায়ামরীচিকায় থেমে যাওয়া সান্ধ্যকীর্তনের রেশ এখনও কেমন কানে আরাম তুলছে। আমি তোমার হাতটি ধরে থাকবো অনন্তকাল। তোমাকে অনেক, অনেক ভালবাসবো আমি। আমরা্ আঁচল ভরে জ্যোৎস্না কুড়াবো। বেলাভূমি পাড়ে শুধু হাঁটবো আর হাঁটবো। হাঁটতে হাঁটতে আমরা দু”জনে চলে যাবো কোনো মহাকালের দিকে। তুমি বাড়িয়ে দাও তোমার হাত। শক্ত করে ধরে ফেলো আমাকে!’
তার হাতটি শক্ত করে ধরা তো দূরের কথা, হাত নড়ানোর একটুও সাধ্য যে আমার আর নেই। হৃদপিণ্ডটা বিদ্ধ করে যে তীরের ফলা আমার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে রেখেছে তার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেহে। এক এক ফোঁটা করে রক্ত ঝরে ঝরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে আমার প্রাণ। আমি ক্রমশ: অসার-স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি। হাতটি নড়াতে পারলে তো আমি আমার বুকে বিদ্ধ তীরটিই খুলে ফেলতাম। অন্য কারো হাত ধরার কোনো চেষ্টা যে এখন আর আমার নেই। এমন অসময়ে ভালবাসার হাত আমার কাছে নিতান্তই মূল্যহীন।
‘এসব ভুলে যাও তো তুমি। চলো আমরা একসাথে বাঁচি। পৃথিবীতে কিছু না থাকুক, আমি তোমার পাশে থাকবো। আমি তোমাকে কখনই একা ফেলে যাবো না। দিনশেষে ফিরেও যদি তোমাকে দেখতে পাই, আমার আর কিছু চাওয়ার নাই। তুমি থাকবে তো আমার পাশে? জবাব দিচ্ছো না কেন? আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।’
শ্রবণেন্দ্রিয় অসাড় হয়ে যাচ্ছে। অস্পষ্ট শুনতে থাকি। আরো কিছু বলে যায় ছায়াটি। ঠিকমতো বুঝতে পারি না। ঝাপসা হওয়ার আগে বুঝতে পারি কেউ আমার মুখে শক্ত করে বালিশ চাপা দিয়ে রেখেছে। দম আটকে যাচ্ছে। আমি দম নেয়ার চেষ্টা করছি প্রাণপনে। না, পারছি না। পারছি না। আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছি। দম নেয়ার হাল, তীর খোলার হাল, যুদ্ধ করার হাল, বেঁচে থাকার হাল। আমি মরে যাচ্ছি। আমি মরে গিয়ে বেঁচে যাচ্ছি বেঁচে থাকার যন্ত্রণা থেকে।
যদি বাঁচতে পারতাম, চেষ্টা করতে পারতাম সর্বশক্তি দিয়ে মুখে চাপানো বালিশটা আগে সরাতে, দম নিতে চাইতাম সবার আগে। তারপর কোন স্বপ্ন দেখতাম কিনা জানি না। যদি হাতটা নড়াতে পারতাম, বুকের হৃদপিণ্ডে বিদ্ধ এফোঁড়-ওফোঁড় তীরটা আগে টেনে খুলতাম, তারপর ভালবাসার হাত ধরতাম কিনা জানি না। যদি জীবন নিয়ে বাঁচতে পারতাম, তবেই বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতাম। কারো কাঁধে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলতাম কিনা জানি না। হয়তো ভালবাসার কবিতা শুনতাম, শুনতাম প্রেমের গানও।
সংসারে ভালবাসা সবার জন্য নয়। কেউ ভালবাসতে আসে, আর কেউ সারাজীবন ভালবাসা পেয়ে যায়। কেউ জীবন যাপন করতে আসে, কেউ প্রাণ নিয়ে ছটফট করে মরে যায়। সাংসারিক ত্রিশূলবিদ্ধ হয়ে কেউ বাঁচতে ভুলে যায়। স্বপ্ন দেখা তার হয় না, ভালবাসা তাকে ছোঁয় না। তারা হাত ধরতে ভুলে যায় আপন যন্ত্রণায়, সাথী চিনতে ভুলে যায় পথের ক্লেশে।
ছায়া, তুমি আমার হাতদু’টি ধরতে হাত বাড়ালেও আমার বুকে বিদ্ধ তীরটাকে টেনে খুলে দিতে পারো না। আমাকে স্বপ্ন দেখাতে চাইলেও তুমি আমার বুক থেকে শেষ বিন্দু রক্ত ঝরানো ঠেকাতে পারো না। ভালবাসতে চাইলেও আমার যন্ত্রণার্ত জীবনের কষ্টগুলো মুছে দিতে পারো না। দুঃসহতা ভুলে যেতে বললেও তুমি আমার গলা থেকে কণ্টকহার খুলে দিতে পারো না।
তুমি অসময়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছো। অসময়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়েছো। এখন যে আমার প্রস্থানের সময়! প্রস্থান কেউ ঠেকাতে পারে না।