আমার প্রতিক্রিয়া ও তোমার রাগ, হে আমার বন্ধু পুরুষ…

শাশ্বতী বিপ্লব: ধর্ষণ নিয়ে, নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে পুরুষের দিকে আঙুল তুললে, তাদের প্রবৃত্তিকে গালি দিলে তোমার রাগ হয়, তুমি ভাবো তোমাকে বললাম বুঝি!! তুমি আমার মানসিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করো, আমাকে প্রতিক্রিয়াশীল, দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবো, বৃথা কেন প্রতিপক্ষ তৈরি করছি সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলো।

Shaswati 4জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে, ধনী গরীবে, সাদায় কালোয় এতো ক্লেদ, এতো রক্তপাত, এতো ঘৃণা, এতো হিংস্রতা পৃথিবীজুড়ে যে শুধু নারীর কষ্ট নিয়ে থাকলে চলে না জানি। নারীদের কষ্ট নিয়ে, লাঞ্ছণা নিয়ে, না পাওয়া নিয়ে, অপমান নিয়ে আলাদা করে খুব বেশি আমিও বলতে চাই না। যদি মানবতা বাদ প্রতিষ্ঠিত হয় কস্মিনকালে, তবে সবকিছুর প্রতিকার হবে জানি। তবুও কথা থাকে; নারী কেবলমাত্র তার শরীরের কারণে এর মাঝে বিশেষভাবে ঘৃণার যোগ্য, আক্রমণের বস্তু!! সেই কথাই  বলবো আজ।

তোমায় যদি কেউ আঘাত করে, অপমান করে, তোমার ন্যায্য দাবি ছিনিয়ে নেয়, তুমি রাগ করো, আক্রোশে ফেটে পড়ো, গালি দাও, পারলে আক্রমণ করো – সেটা তুমি পারো, তোমার জন্য সেটা ন্যায্য। কারন তুমি পুরুষ।

কিন্তু একইরকম কারণে আমি  রাগ হলে, ক্ষেপে গেলে, চিৎকার করলে, গালি দিলে তোমরা রাগ করো।অতি প্রতিক্রিয়াশীল, দায়িত্বজ্ঞানহীন বলে গালি দাও। কেন? কারণ আমি নারী।

তুমি আমার ভাই, বাবা, শিক্ষক, বন্ধু, প্রেমিক, জীবনসঙ্গী আরো কত কী! একটা নির্দ্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে তোমার সাহায্য ছাড়া আমি একা চলতে অপারগ, তা সে আমি যতোই যোগ্য হই না কেন। সেই অপারগতার কারণটা কখনো ভেবে দেখেছো কি? কাদের ভয়ে সেই ছোট্ট বেলা থেকে আমাকে তোমার ঢেকে রাখতে হয়, আগলে রাখতে হয়? কী সেই আমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা তোমার মাথা ব্যাথার কারণ? আমার শরীর, তাই নয় কি?

তুমি আমার ধর্ম, আমার সমাজ, আমার আইন-আদালত; আমি নিছকই একজন বিচারপ্রার্থী!! আমার প্রতি তোমার সহানুভুতি ততক্ষণ, যতক্ষণ আমি কাঁদি, আত্মসমর্পণ করি, প্রতিকারের আকুতি জানাই তোমার কাছে। কিন্তু আমি যদি আকুতি জানাতে অস্বীকার করি, অপমানে, আক্রোশে চিৎকার করি, তোমার কাছে সেটা বাড়াবাড়ি, সেটা নারীবাদ, সেটা অপরিণামদর্শিতা বা বেশি বোঝা। জানো তো, তোমার এই অভিব্যাক্তির সাথে সাথে আমারও তোমার সচেতনতার ব্যারোমিটারটা মাপা হয়ে যায়।

আমার স্কুলে আসা যাওয়ার পথে যে দাঁড়িয়ে থাকে – ওরা কারা? কর্মক্ষেত্রে একা বা দলবদ্ধভাবে যে আমাকে ভোগের পরিকল্পনা করে – ওরাই বা কারা? বাসে, ট্রেনে, বাজারে, দোকানে কাদের ভয়ে তুমি আমায় পাহারা দাও?  

সেদিন এক/দেড় বছরের হিজাব পরা যে শিশুটিকে দেখলাম বাবার কোলে – সেই বাবা কার কাছ থেকে এখন থেকেই তার মেয়েকে আড়াল করতে চাইছেন?

Stop Violence Collageকৈশোরে তুমি যখন বাইরের দুনিয়া দেখার ছাড়পত্র পেয়েছো, আমার জন্য তখন বাড়তি অনুশাসন যুক্ত হয়েছে। যৌবনে তুমি আরো স্বাধীন হয়েছো, কত দূর-দূরান্তে ছুটে বেড়িয়েছো দলবল নিয়ে। জীবনকে উপভোগ করেছো যেমন চেয়েছো তেমনভাবে। আমিও গেছি কখনো-সখনো, যদি তুমি সাথে আছো তবেই। যদি সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে তবেই। সেই অনিরাপত্তার কারণ কারা?  

ঘর, সংসার, সন্তান – তুমি হাঁপিয়ে ওঠো কখনো-সখনো। মুক্ত বাতাসের খোঁজে বের হয়ে যাও যখন-তখন। তোমাকে রাতদিন হিসাব করতে হয় না, তোমার সাথে কে আছে হিসাব করতে হয় না। আমারও হাঁসফাস লাগে, আমিও বের হতে চাই, আমার তোমাকে লাগে, আমার দিনের আলো লাগে; রাত আমার জন্য নিষিদ্ধ। কাদের ভয়ে?

তুমি দাবি করেছো, তুমি সবার মতো নও। তবে কেন তোমার গায়ে লাগে!! তোমাকে বুঝাতে আমার প্রেক্ষিত তৈরি করতে হয়!! মনে করিয়ে দিতে হয় তুমি আমার জঠরে বড় হয়েছো, আমি তোমার মা, তোমার বোন….কেন? আমার থেকে তুমি জন্ম না নিলে বা আমি-তুমি একই মায়ের জঠরে না জন্মালেই তুমি আমাকে আঘাত করতে পারো!! কারণ, তোমার ক্ষুধা প্রাকৃতিক, তোমার আকাংক্ষা যৌক্তিক, বাহ্!!

তুমি বলেছো তুমি তনুর ভাই, তনু হত্যার বিচার চাও। কেউ বলেছো, তুমি তনুর বাবা, তনু হত্যার বিচার করতে হবে।আমি বলি, আমি তনুর কেউ নই। ওকে আমি কোনদিন দেখিনি। তবু তনু হত্যার বিচার চাই। তনু একজন মানুষের (!) নাম, যাকে কিছু অসুস্থ জন্তু ছিঁড়ে খেয়েছে।

এক ডাক্তার দম্পতির কথা। ভোর রাতে বউটি টয়লেটে যাওয়ার সময় দেখেছিলো তার বাসার ১২/১৩ বছরের গৃহকর্মীটির প্যান্ট পাশে খুলে রাখা। মেয়েটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করায় ঘুম জড়ানো চোখে বলেছিল, ‘খালু খুলসিলো, রোজ খুলে’…সেই সংসারটাও টিকে আছে!! সন্তানের দায়, সমাজের দায় মেটাতে। সেই ডাক্তারের নিজেরই একটা ওই বয়সী মেয়ে আছে যদিও!!! সেও একজন ভদ্রলোক হিসেবেই পরিচিত, হয়তো কোথাও না কোথাও তনু হত্যার বিচার চাইছে।

তুমি আমায় বেড়া দিয়ে রাখো। কারণ তোমার মতোই দেখতে কিছু দুপেয়ে শ্বাপদ কোথাও না কোথাও ওৎ পেতে থাকে আমার শরীরের জন্য। সেই বেড়ায়ও ক্ষেত খেয়ে উজাড় করে, আর আমার উপর ডিপ্লোমেটিক হওয়ার দায় বর্তায়!!

Feminisimতুমি ধর্ষক নও, জানি। সবাইকে ধর্ষক হতে হয় বুঝি? যে পথচারী আমাকে উত্যক্ত করে, সে সহযাত্রী ভিড়ে আমায় লাঞ্ছিত করে, যে শিক্ষক আমাকে একা পেয়ে আমার গায়ে হাত বুলায়, সে সহকর্মী আমার দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেয়, যে বন্ধুটি পতিতালয়ে যায় – তারা সবাই কারো বাবা, কারো ভাই, কারো স্বামী, কারো পুত্র, আমার তোমার বন্ধু বা আত্মীয়। সেটা তোমার চেয়ে ভালো আর কে জানে!

তুমি বলেছো, তুমি অন্যদের মতো নও। তুমি সচেতন পুরুষ। তুমি নারীকে সম্মান করো। তুমি আলোকিত। তোমার বিভিন্ন প্রশিক্ষণ আছে, তোমার অনেক বড় বড় তত্ত্ব পড়া আছে। তুমি নারী নির্যাতনবিরোধী জোটে কাজ করো। তুমি পলিসি বানাও। বাহ, বেশ।

আমি বলছি, তুমি কেবল তত্ত্বই মুখস্ত করেছো বন্ধু, তার সার বোঝোনি। তাই, পুরুষের ধর্ষণ প্রবৃত্তিকে গাল দিলে তোমার মনে লাগে। গণধর্ষণের খবরে আমি কাঁদলে তুমি অবাক হও। অন্যায় হয়েছে মানো, কিন্তু এতো ইমোশনের কী আছে বুঝতে পারো না!! তুমিও প্রতিবাদ করো, আমি দেখেছি। তবে সেটা এক নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে এসে আটকে যায়।  তাই আমার আজন্ম শত্রু যে নিজের শরীর, তা নিয়ে কথা বললেও সেখানে তুমি তোমার অপমান দেখতে পাও, প্রতিপক্ষতা দেখতে পাও, কেবল দেখতে পাও না রক্তক্ষরণ। যদিও আমার দৌড় ওই লেখা পর্যন্তই!!!

প্রতিপক্ষ কাকে বলে বন্ধু? তোমার সন্মান আমার শরীরে নিহিত। পাহাড়ে বা সমতলে, উন্মুক্ত রাজপথে বা ঘরের কোনে, যুদ্ধে কিংবা শান্তিতে – তোমাকে ঘায়েল করার সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আমার শরীর। আমার শরীরকে ছিন্নভিন্ন করতে পারলে তোমাকে সবচেয়ে বেশি অপমান করা যায়।

ভেবো না তনুর মৃত্যুতে সবাই দুঃখিত। সে নিজেকে ঢেকে রাখলেও কলেজে যেতো, থিয়েটার করতো। তাকে মেরে ফেলা উচিত শিক্ষা হয়েছে মনে করে অনেকেই। এই বিকৃত মানুষগুলোর যারা বিরোধিতা করছে, তারাও তাকে গালি দিচ্ছে সেই মা-বোন তুলেই!! কী নিদারুণ প্রতিবাদ, তাই না!! তনু তোমাদের সব শর্ত পূরণ করতে পারেনি। হয়তো অন্য কোনদিন অন্য কোন তনু তোমাদের দেয়া অন্য শর্তগুলোও পূরণ করবে, তবু শেষ রক্ষা হবে না। আর সেটা প্রমাণ করতে আমাদের আরো মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

লক্ষীপুরের এক মাকে সন্তানের সামনে বিবস্ত্র করে পিটিয়েছে আরেক নারী, তার কারণও সেই শরীর।তুমি বলবে, দ্যাখো নারীই কেমন নারীর শত্রু। তার পেছনের কারণ নিয়ে তুমি চুপ থাকবে। নির্যাতনকারী নারীর স্বামীর কুনজর পড়েছিলো যে সেই মায়ের উপর, সেটা কৌশলে পাশ কাটিয়ে যাবে।

নারী বা পুরুষ নয় হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে যেদিন তুমিও পুরুষের এই প্রবৃত্তিকে নির্দ্বিধায় গালি দিবে; তোমার প্রতিবাদে যেদিন কোন কিন্তু-তবে থাকবে না; ধর্ষণকে, যৌন নিপীড়নকে একজন মানুষের প্রতি আরেকটি মানুষের অন্যায় হিসেবে দেখবে –  সেদিন বুঝবো তুমি সত্যিই আলাদা, আলোকিত মানুষ। আমার কাতারে এসে দাঁড়াতে পারো যদি তবেই বুঝবো তুমি আমার প্রকৃত বন্ধু।

” যতদিন ভবে, না হবে না হবে,
তোমার অবস্থা আমার সম।

ঈষৎ হাসিবে, শুনে না শুনিবে
বুঝে না বুঝিবে, যাতনা মম।”

 

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.