সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: পাকিস্তানি আর্মির ক্যাম্প থেকে জীবিত ফিরে এসেছিলেন কুড়িগ্রামের যেকজন নারী, তাদের সতীত্ব নিয়ে অগ্নিপরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। যখন পরিবার-সমাজ তাদের গ্রহণ করছিল না, তখন তারা প্রাণপনে চেষ্টা করে পরীক্ষা দিতে চেয়েছিলেন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের, সতীত্বের।

না, তখনও সমাজ তাদেরকে সতী বলে মানেনি। স্বামীর ঘর থেকে, বাবার হাত থেকে জোর করে ধরে নিয়ে গেলেও তার পুরো দায় চাপিয়ে দিয়ে অপরাধী করা হয়েছিল ধর্ষণের শিকার সেই নারীদেরই।
এবার আবারো তারা পরীক্ষা দিচ্ছে। কখনও মিডিয়ার ক্যামেরায়, কখনও তদন্ত কমিটির রেকর্ডে। এবারের পরীক্ষা সতীত্ব প্রমাণের নয়, বরং কতটা নির্মমভাবে তার সতীত্ব হরণ করা হয়েছিল তা বর্ণনা করার পরীক্ষা। ঘটনার উপযুক্ত প্রমাণও দেখাতে হবে!
৪৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার দিন-ক্ষণ উল্লেখ করে বয়ান করতে হবে কোন পুরুষের সাক্ষিতে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেদিন! কোন ক্যাম্পের কোন কোন পাকিস্থানী আর্মি তাদের ধর্ষণ করেছে, কিভাবে তারা বেঁচে গেছে আর কেনই বা তারা বেঁচে গেছে তার উপযুক্ত প্রমাণ এবার চাই! তাছাড়া তাদের বীরাঙ্গনা স্বীকার করা হবে না!
এবারের এই বীরাঙ্গনার স্বীকৃতি মানেই যে মুক্তিযোদ্ধার খেতাব! তাই এতো বছর যারা বীরাঙ্গনা হওয়ার অপরাধে ঘরছাড়া হয়েছে, পরিবার ছাড়া হয়েছে, সমাজ ছাড়া হয়ে রাস্তার কুকুরের মতো জীবনযাপন করেছে, তারাই আজ আবার পরীক্ষা দিচ্ছে আসল বা নকল বীরাঙ্গনা বাছাইয়ের পরীক্ষায়। এই পরীক্ষায় তারা এখনও পাশ করতে পারেনি।
স্বাধীনতার মাসে ২৬ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা দেয়া হলেও কুড়িগ্রামের বীরাঙ্গনারা তাতে স্থান পাননি। কারণ আরো কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে তাদের। হাজির করতে হবে আরো উপযুক্ত প্রমাণ-সাক্ষী। কুড়িগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে আজো বেঁচে আছেন যে কয়েকজন বীরাঙ্গনা নারী, তাদের যুদ্ধ এভাবে চলছে আজও। মুক্তি বহুদূর। পাকিস্তানিরা চলে গেছে ৪৫ বছর আগে। এখনও কখনও পরিবার, কখনও সমাজ, কখনও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে তারা নিগৃহীত হচ্ছে এই নারীরা।
ক্যাম্প থেকে যারা ফিরে এসেছিল, তাদের কারো আশ্রয় হয়েছে বাবার বাড়িতে, কারো আশ্রয় মানুষ তো দূরের কথা, জঙ্গলও দিতে চায়নি। যারা এতটুকু আশ্রয় পেয়েছে, তাদেরকে ঘরে-বাইরে নানা গঞ্জনা শুনে বেঁচে থাকতে হয়েছে।
শুধু স্বামীই মেনে নেয়নি এমন নয়, যে স্বামী মেনে নিয়েছে, তাকেও বাড়িছাড়া হতে হয়েছে, সমাজচ্যুত হতে হয়েছে। যখন কোন স্বামী বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে তখন আপন মা সেই নির্যাতিতা মেয়ের দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারেনি। মেয়েকে নিজ বাড়িতে নিয়ে এসে আশ্রয় দিয়েছিল বলে বাবাও মাকে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, বাবা আবারো বিয়ে করে সংসারি হয়েছে।
প্রথমে শারীরিক ও পরে সামাজিক নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যা করছে। এসবের পরেও যারা দীর্ঘপ্রাণ নিয়ে বেঁচে আছেন বা ছিলেন, তারা রোজ রোজ মরছেন মানুষের বিষকথায়।
তাদের ভাষায়, আশ্রয়হীন হয়ে যারা কলাগাছের ঝোঁপে, গাছের তলায়, পরিত্যক্ত বাড়িতে সেইসময় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা আবারও এদেশীয় হায়েনাদেরই লালসার শিকার হয়েছেন দিনের পর দিন। দিনের আলোয় যে সমাজ তাদের ‘সম্ভ্রম’ বাঁচাতে না পারার অপরাধে গৃহহীন করেছে, রাতের আঁধারে সেই বিচারপতিই খুুবলে খেয়েছে আবারও তাদের ‘সম্ভ্রম’।
মজিদাকে (৬২) যেদিন তুলে নিয়ে যায় আর্মিরা, সেদিন তিনি বাবার পাশে দাঁড়িয়ে বাড়ির সামনের ক্ষেত থেকে পাট শাক তুলছিলেন। আর্মি এসে যখন মজিদাকে ধরে ফেলে তাকে উদ্ধার করতে বাবা আর্মির পা জাপটে ধরেছিলেন। আর্মিরা মজিদাকে তো ছাড়েইনি। তার চোখের সামনে বাবাকে গুলি করে মেরেছিল।
নাগেশ্বরী ডাকবাংলো ক্যাম্পে কতদিন কেটেছে মজিদার, তিনি মনে করতে পারেন না। তবে যখন তার জ্ঞান ফেরে নিজেকে তিনি বিবস্ত্র অবস্থায় বিলের ধারে পড়ে থাকতে দেখতে পান। পাশ দিয়ে এক পথচারীকে যেতে দেখে মজিদা গোঙাতে থাকেন। পথচারী তাকে গামছা পরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে তুলে এক বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তিনি যখন নিজের গ্রামের বাড়ি রামখানায় পৌঁছান, ততোদিনে তার বাবার কবরে ঘাস গজিয়ে উঠেছে। বাড়িতে মা-ভাই-বোন তাঁকে আশ্রয় দিতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্রামবাসী তাঁকে ‘কলঙ্কিনী’ ‘পাপী’ আখ্যা দেয়ায় মা- ভাইও মুখ ফিরিয়ে নেয়। দেশ স্বাধীন হলে সে মা-ভাই-বোন মজিদাকে একা ফেলে ভারতে চলে যায়। তারপর থেকে মজিদা বেওয়া আর পরিবারের খোঁজ পাননি। তারা বেঁচে আছেন না মরে গেছেন তাও জানেন না তিনি। সারা জীবন তিনি জেলা শহরে দূর অঞ্চল থেকে আসা ভাড়াটে পরিবারগুলোর বাসায় কাজ করেছেন। এলাকার কোন মানুষ তাকে কাজেও নিতে চাননি।
তিনি জানান, সারাজীবন বীরাঙ্গনা হওয়ার অপরাধের শাস্তি পেলাম, এতো বছর পর যখন আমি নিজে নিজেকে বীরাঙ্গনা বলছি, তখন আবারো পরীক্ষা নিচ্ছে। আমি নাকি আসল বীরাঙ্গনা না। তাই যদি হবে তো দেশকে বলছি, আমার জীবন ফিরিয়ে দেওয়া হোক। আমার বাবা, আমার পরিবার, আমার সংসার ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
ছালেহা বেওয়াকে (৬৩) ধরে যখন আর্মিরা তুলে নিয়ে যায় তখন সকাল। স্বামী ইসাহাকের রান্না ঘরে ভাতের ফেন তুলছিলেন। যেদিন ফিরে এসেছিলেন, সেদিন আর সে বাড়িতে ফেরা হয়নি। সারা জীবন কেটেছে বাবার বাড়ি শিবরাম, কাঁঠালবাড়িতে। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ, কৃষি জমিতে ফসল লাগানো, ফসল তোলা, মাটি কাটার কাজ করে জীবন চলেছে। এই বয়সে এসে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় আছেন।
তার বাড়িতে গেলে তিনি জানান, আর্মিরা আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে তার দায়ে আমাকে কলঙ্কিত করেছে সমাজ। সারাজীবন আমি এতো কষ্ট করে গেলাম, মরণের আগেও যদি সরকার আমাদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিতো, তবে শান্তিতে মরতে পারতাম। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিৎসায় পথ্যও জোটে না আমার। যে পাপ আমি করিনি, তার কেন প্রায়:শ্চিত্ত আমাকে করতে হচ্ছে?
গেন্দি বেওয়ার (৬৩) স্বামী আছর উদ্দিনকে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মেলামেশার খবর কেউ পাকিস্তানি আর্মিদের জানিয়ে দিয়েছিল। সেই অপরাধে তাকে ধরতে বাড়িতে হানা দেয় আর্মিরা। তারিখ মনে নাই। তবে যুদ্ধ শেষের তিন মাস আগের কথা। সকালের খাবার তখনও খাওয়া হয়নি কারো। সেদিন জনা দশেক আর্মি বুটের খট খট আওয়াজ তুলে বাড়িতে ঢুকে পড়ে তখন ভাতের মাড়ে গদগদ আওয়াজে হচ্ছিলো। টেরই পায়নি গেন্দি। আর্মিরা যখন এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে, কোনো কথা বলারও সুযোগ দেয়নি। আছর উদ্দিনের বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে বের করে নিয়ে যায় কয়েকজন আর গেন্দিকে বেওয়াকে তুলে নিয়ে যায় বাকীরা। তারপর গেন্দি বেওয়া যখন ফিরে এসেছিলেন আর স্বামীর বাড়ি, বাবার বাড়িতে কোথাও তাকে আর ঢুকতে দেয়া হয়নি। কলাগাছের ঝোঁপে, স্টেশনে পড়ে থেকে তার দিন-রাত কেটেছে। ভেবেছিলেন স্বামী ফিরে এলে হয়তো বাড়ির লোকজন, গ্রামবাসী, সমাজকে বোঝাবেন, যে ঘটনা ঘটে গেছে তাতে গেন্দির কোনো অপরাধ ছিল না। কিন্তু সেই স্বামী আর কখনও ফিরে আসেননি। পরে শুনেছিলেন আছর উদ্দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই গুলি করে হত্যা করেছিল আর্মিরা। স্বামীর লাশের কোন খবরও দিতে পারেনি কেউ।
তিনি জানান, সেসময় রাস্তায় বের হলে লোকজন কুকুর লেলিয়ে দিতো। ‘কী যে কষ্টের দিন কেটেছে সারাজীবন কীভাবে তা বর্ণনা করবো জানি না। এসব কথা বলতে আর ভালো লাগে না। এর চেয়ে মরে গেলেই বেঁচে যেতাম’।
আবিরন বেওয়া(৬২) যেদিন আর্মি ক্যাম্প থেকে ফিরে অাসেন তার স্বামী তো তাকে গ্রহণ করেনইনি, সমাজের ভয়ে বাবাও তাকে বাড়ি থেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল। মা তাকে ঘরে নিয়ে আসায় বাবা মাকেও বের করে দেন।
তারপর থেকে মা ও ছোট বোনের সাথে তার সারাজীবন কেটেছে বিধবা নানীর বাড়িতে। ছোট বোন জোনাকি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেলে সেই সন্তান শেফালীকে বুকে নিয়ে আবিরন বড় করেন। কিন্তু শেফালীকে যেখানেই বিয়ে দিতে গেছেন, কলঙ্কিত পরিবারে জন্ম বলে তাকে কেউ বউ বলে মেনে নেয়নি।
আবিরন বলছিলেন, ‘আমি যদি বীরাঙ্গনা না হয়ে থাকি তবে আমাকে আজো কেন সমাজই কলঙ্কিনি বলে? আজো কেন শেফালীকে তার শাস্তি ভোগ করতে হয়? আমার আর কোন পরীক্ষা নিতে চায় সরকার? মরলে যেন পোস্টমর্টেম করে দেখে নেয় আমার অপরাধ!
কুড়িগ্রামে এই বীরাঙ্গনাদের মতো ৩১ জন এখনও বেঁচে আছেন। যারা বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দেয়ার সরকারের ঘোষণা শুনেছেন। কী সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে তার হিসেব তারা করে না। তারা শুধু তাদের না করা অপরাধের কলঙ্কের দায় থেকে মুক্তি নিয়ে মরতে চায়।
স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরেও যখন নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধারা তালিকায় সংযুক্ত হচ্ছে। এখানে আসল নকলের তেমন কোন বালাই নেই। যখন যে দল ক্ষমতায় ছিল বা আছে সে দলের মদদপুষ্ট হয়ে তালিকায় নাম উঠাচ্ছে এই মুক্তিযোদ্ধারা। এমনকি যুদ্ধাপরাধী রাজাকারও সেই সুবিধা পেয়েছে অবলীলায়।
কিন্তু বীরাঙ্গনাদের তালিকা করতে কোন দলই তেমন আগ্রহ দেখায়নি। যেহেতু তারা নারী। তাই এই নারীর দলের নাম ‘নারী’ই। অন্য কিছু নয়। নারীরা মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পাবে এই বাছাইয়ে তাই আবারো তারা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। ৪৫ বছর আগের ক্ষত যেখানে বঞ্চনা ও অত্যাচারের ধুলা জমে জমে ঢাকা পড়েছে, তাকে আবারো খুঁচিয়ে দগদগে করা হচ্ছে। আবারো তাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে সন্দেহের প্রশ্নে।
কেন এতোটা বছর তারা নিজেকে বীরাঙ্গনা দাবি করেনি? সেসময়ের ৬/৭ বছরের শিশুটিও যখন নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে তখন বীরাঙ্গনারা নিজের পরিচয় কেন লুকিয়েছে? মুক্তিযোদ্ধা দাবি করা যে সম্মানের, স্বার্থের, আর বীরাঙ্গনা কলঙ্কের। বীরাঙ্গনাকে সম্মান করা হলে আরো অনেক দাবিদার উঠে দাঁড়াবে যারা সম্ভ্রান্ত পরিবারের সম্মানের দামী দোপাট্টায় মুখ ঢেকে এতোকাল কাটিয়েছে। তখন আর পরীক্ষার দরকার পড়বে না। তখন আর কলঙ্কের থাকবে না এই পরিচয়।
লেখক সাংবাদিক
রাষ্ট্রকেও ধর্ষক বলা যায়! রাজনীতি যে কতটা অমানবিকতায় চলছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্ষক রাষ্ট্র প্রত্যেক বীরঙ্গনার সন্মান ফিরিয়ে দিক।