পাঁচালির প্যাচাল-২

অনুপা দেওয়ানজী: সাদা থান, মুণ্ডিত মস্তক, নিরাভরনা, ক্লিষ্ট আহারে দিনাতিপাত করা নারীদের বিয়ের তথাকথিত মাঙ্গলিক কাজ থেকেও বিরত রাখা হলো। কারণ তার যে স্বামী নেই। অথচ ভাগ্যবান বিপত্নীক পুরুষটি দিব্যি বিয়ের আসর আলোকিত করে বসে থাকেন। আর স্বামীহারা মেয়েটির সেখানে যেতেও মানা!

Anupa Dewanji
অনুপা দেওয়ানজী

তবে নাবালক সন্তানদের আর মাকে হারাবার ভয় রইলো না, আর মাকেও তাঁর আদরের সন্তানদের অসহায় করে জ্বলন্ত চিতায় পুড়ে মরতে হলো না। এটাই বা কম কীসে!

প্রাণ রক্ষা হলেও সন্তানদের নিয়ে এবারে তাঁদের কী বাপের বাড়ি, আর কী শ্বশুর বাড়ি যুগপৎ উভয় জায়গাতেই শুরু হলো অপমানিত ও লাঞ্ছিত এক জীবন! মুষ্টিমেয় কিছু নারী যাদের স্বামী তাঁদের স্ত্রীদের জন্য কিছু রেখে যেতেন, তাঁরা ছাড়া বাকি সবার জীবনে নেমে আসলো এক করুণ পরিণতি।আবার কেঁদে উঠলো ঈশ্বরের মন।

এবারে আবির্ভূত হলেন যিনি, তিনি নামেও ঈশ্বর আর কাজেও স্বয়ং নররূপী ঈশ্বরই বটে। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মাঝে মাঝে ভাবি, মানুষ কতো অখ্যাত গুরুর কাছে ধর্না দিয়ে দীক্ষা নিতে যায়, অথচ মানব কল্যাণের জন্যে পথিকৃৎ এই দুই মহাগুরুর কথা আমরা কতোজন মনে রাখি?

সেকি তাঁরা দুর্ভাগা মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বলে? আমাদের পুজোর ঘরে, ঘরের দেয়ালে অসংখ্য দেবদেবী বা গুরুর ছবি অহরহ ঝুলতে দেখা যায়। কতো জনের ঘরে এই দুই গুরুর ছবি আমরা রাখি? যদিও আমরা জানি ‘জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’ বিবেকানন্দের এই উক্তি বা এর প্রয়োগ এইসব বিধবা মেয়েদের জন্যে কি বাদ দিয়ে?

সতীদাহ প্রথা রোধ হওয়াতে বিধবাদের সংখ্যা বেড়ে গেল, কিন্তু তাদের নিয়ে ভাববার মতো কেউ নেই। উল্টো তাদের কোনরকম সুস্থ জীবনেরও ব্যবস্থা হলো না।

Hindu 2ফলে শুধুমাত্র পেটের অন্ন জোগাতে কিছু বিধবা দেবদাসী [এদের সম্পর্কে কিছু লিখতে চাইনা। ধর্ম গুরুরা আপত্তি তুলতে পারেন বা ক্ষেপে যেতে পারেন] কিছু বিধবা পতিতাবৃত্তি আর বাকিরা দুঃসহ এক জীবন নিয়ে বাবার বাড়ি বা শ্বশুর বাড়িতে অনেকটা দাসীর মতোই জীবন কাটিয়ে দিতে লাগলো।

করুণার সাগর বিদ্যাসাগর এইসব বিধবাদের আবার যে শুধু বিয়ের ব্যবস্থা করলেন তাই নয়, নিজের ছেলের সঙ্গে দৃষ্টান্তস্বরূপ বিধবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে পুত্রবধু করে ঘরে তুললেন।

ধর্মীয় গুরু আর স্বার্থান্বেষী পুরুষ সমাজের মুখে পড়লো কুলুপ।

কারণ যেখানে তখন মানুষ গৌরী দানের পূণ্য সঞ্চয়ের নামে ছয় বা সাত বছরের মেয়েদের বিয়ে দিত, সেখানে কিনা বিধবা বিয়ে! অথচ এই ছয় বা সাত বছরের কত গৌরীকে যে ফুলশয্যার রাতে বয়সে তার চেয়ে চার পাঁচগুন বড় পাষণ্ড স্বামীর কাম চরিতার্থ করতে গিয়ে নিদারুণ যন্ত্রণায় চিৎকার করতে হতো, আর পাশের ঘরে তার শ্বশুর-শাশুড়ি সে আওয়াজ সইতে না পেরে কানে আঙ্গুল দিয়ে থাকতেন, তার খবর কতজন জানে?

প- তি- তা! আচ্ছা শব্দটি প্রথম কার মাথা থেকে বেরিয়েছিল?

এমন একটি শব্দ কার উর্বর মাথা থেকে বেরিয়েছিল আর এর কোন পুরুষবাচক শব্দই বা নেই কেন? অদ্ভুত ব্যাপারই বটে! মেয়েটিকে পতিতা বানাবার জন্যে যে একজন পতিত পুরুষেরও দরকার, সে তো আর আপনা থেকে পতিতা হয়নি। তথাকথিত পতিতা যাকে বলা হচ্ছে, তাদের কাছে রাতের অন্ধকারে পতঙ্গের মত ছুটে আসা পুরুষগুলি কী করে ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে গেল?

আর পেটের জ্বালা সইতে না পেরে যে মেয়েটিকে এই পথ বেছে নিতে হয়েছে, সে হয়ে গেল পতিতা! আমরা এও জানি পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসা হলো দেহ ব্যবসা। তাহলে আবার বড় মুখ করে বলার দরকার কী, বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী? ওটা কি তবে ব্যবসা নয়?

এই বারাঙ্গনা দ্বারের মাটি ছাড়া দুর্গা মায়ের পুজো হয় না, এর কারণ হলো পুরুষ যখন কাম চরিতার্থ করবার জন্যে বারাঙ্গনার দ্বারে যায় তখন তার সমস্ত পূণ্য বারাঙ্গনা দ্বা্রের মাটি শোষণ করে নেয়, তাই এই দ্বারের মাটি অত্যন্ত পবিত্র। তাহলে পুরুষদের পূণ্য আর রইলো কোথায়? সেতো পাপী হয়েই একজন পতিতার কাছে যাচ্ছে। স্বয়ং জগজ্জননীর পুজোতেই যে তার প্রমাণ।যাকগে আমি বোধহয় ধান ভাণতে গিয়ে শিবের গীত গাইছি। (চলবে)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.