আমার উপলব্ধি এবং আমার মায়ের কৈশোর

শাহাদাত রাসএল: ভনিতা করার সুযোগ নেই, নারী বরাবরই আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় তার জেন্ডারগত কারণেই। কিন্তু নারীকে কখনোই আমার কাছে বন্ধু, সহযোদ্ধা, সহযাত্রী ছাড়া অন্য জাগতিক কিছু মনে হয়নি। তবে শুরু থেকেই নারী বিষয়ে সাহিত্যে কিছু উপমা বা প্রচলিত মত পড়তাম, যা কখনোই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। যেমন “ঈশ্বরও নারীর মন বোঝে না” টাইপ বাণী।

Raselএইতো গতসপ্তাহে একটা আড্ডায় আমার এক স্কুল শিক্ষক বিদগ্ধ পুরুষ বন্ধু কিছু মনীষীর কোট করে বললো যে, নারী হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয়, যা পুরুষের বোধের বাইরে থাকে। সেখানে উপস্থিত ছিল আমার প্রিয় সিনিয়র কিছু নারী বন্ধু যারা পেশায় কলেজ শিক্ষক, সাংবাদিক, আর্কিটেক্ট। সেই নারী বন্ধুরাও পুরুষ বন্ধুর নারী বিষয়ক বক্তব্যে উচ্ছল উজ্জল হয়ে উঠলো। তাদের কপোলে একটু অহংকার আর গর্বের লালিমাও দেখা গেলো এক ঝলক।

আমি হয়তো খুব বেশি সাহিত্য বুঝিনা বলেই আমার কাছে বরাবরই নারীর মনকে সহজ আর সাধারণ মনে হয়।

আমি আমার জীবনে যতো নারীর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কে জড়িয়েছি, সম্পর্কটা মা হোক বোন হোক অথবা প্রেমিকা, আমার কাছে কিন্তু তাদেরকে বুঝতে কখনোই সমস্যা হয়নি। প্রতিটি মানুষের ভাবনার স্রোত একই ধারায় যেহেতু বহেনা, সেহেতু সবার সব ভাবনা সবাই চট করে ধরে ফেলতে পারেনা।

যেমন আমার অনেক ছেলে বন্ধু আমার মনের ভেতরকার ভাবনার অনেক বিষয়ই ধরতে পারেনা। আমিও পারিনা। তবে আমি আমার একজন পুরুষ বন্ধুর মন বা ওর ভাবনা যতোটা সহজে বুঝতে পারি, ঠিক ততোটাই সহজে বুঝতে পারি আমার মেয়ে বন্ধু, প্রেমিকা বা মায়ের মন বা ভাবনা।

আর নারীর যেটুকু আমি বুঝতে পারি না সেটা পুরুষের ক্ষেত্রেও বুঝতে পারি না। নারীর চাওয়া পাওয়া স্বপ্ন-কল্পনা ব্যক্ত অব্যক্ত কথা কোনটাই আমার কাছে পুরুষের চেয়ে আলাদা বা দুর্বোধ্য মনে হয় না। কেননা নারীর কান্না আর হাসির সাথে আমি পুরুষের কান্না বা হাসির অনুভূতিগত তফাত খুঁজে পাইনা।

বরং আমার বরাবরই মনে হয়েছে যে পুরুষ যখন কোন নারীর অনুভূতি বুঝতে অক্ষম হয়, বা নারীর ভাবনাটাকে ছুঁতে ব্যর্থ হয়, কিংবা নারী চাওয়া পাওয়ার প্রশ্নটাকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে যেতে চায়, তখনই নারীকে দুর্বোধ্য আখ্যা দিয়ে পুরুষ তার নিজের অক্ষমতা বা চতুরতাকেই আড়াল করতে চায়। আর আমাদের নারীগণও পুরুষের চতুর স্তুতিবাক্য শুনে বারবার বোকাবোকা লাজুক অহংকারে উজ্জল হয়ে উঠেছে।

নারীকে দুর্বোধ্য বলে প্রতিষ্ঠিত করায় পুরুষের লাভ রয়েছে, লাভ রয়েছে পুরুষতন্ত্রের। কিন্তু এইসব সস্তা স্তুতিগান নারীর কোন উপকারে এসেছে বলে মনে হয়না। বরং এইসব চতুর রসালো স্তুতিবাক্য নারীর হাতে পায়ে বাঁধা পুরুষতন্ত্রের অদৃশ্য গোলামির শেকলকেই আরো মজবুত করেছে।

নারী পুরুষ উভয়েই সমান সত্য সহজ সুন্দর মানুষ হয়ে উঠুক এইটুকুই কামনা।

আমার মা একসময় স্কুলে-কলেজে পড়তেন, সে স্কুলে যাবার পথে মাঝে মাঝে কিছু বখাটে ছেলে আমার মা’কে লক্ষ করে সিটি বাজাতো, নোংড়া মন্তব্য করতো, আমার মা খুব বিব্রতবোধ করতো, তার কষ্ট হতো, তার কান্না পেতো। পরের দিন স্কুলে যেতে আমার মা ভয় পেতেন । কলেজে যাবার সময়েও আমার মায়ের সাথে একই ঘটনা ঘটতো। আবার তার কান্না পেতো।

আমি রাস্তার ফুটপাতে বসে সিগারেট টানতে টানতে এই ভাবনাটা ভাবছি, আমার মায়ের সেদিনের মানসিক অবস্থা ভেবে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমাদের সমাজটা এমন কেনো ?
আমার সামনে দিয়ে তিন-চারজন কলেজ পড়ুয়া মেয়ে উচ্ছলভাবে হাসতে হাসতে যাচ্ছে। আমি চাইলে একটা সিটি বাজিয়ে বা একটা মন্তব্য করে ওদের হাসিমুখটা বিবর্ণ করে দিতে পারি। ওদের চোখে জল এনে দিতে পারি।
না থাক। ওরা একদিন আরো বড়ো হবে, ওরাও মা হবে। হয়তো ওদের ছেলেও একদিন আমার মতো বসে বসে তার মায়ের কুৎসিত কৈশোরের কথা ভেবে আমার জন্য ঘৃণার থুতু জমাবে। আমি কারো মাকে অপমান করতে চাইনা, যেমন চাই না আমার মায়ের অপমান দেখতে।

অনেকগুলো আমি মানেই আমরা। অনেকগুলো আমরা মানেই বাংলাদেশ। অনেকগুলো বাংলাদেশ মানেই পুরো পৃথিবী। আর নারী মানেই মা, আপনার মা আমার মা অথবা আমাদের আগামি প্রজন্মের মা। পৃথিবীর সকল মায়ের শৈশব আর কৈশোর নিরাপদ হোক।

শেয়ার করুন:

শাহাদাত রাসেল, ঈশ্বর আপনার মত সবাইকে গড়লে দেশে অপরাধ, অন্তত: মেয়েদের বেইজ্জতি করার অপরাধ থাকতই না। ইসলাম ও কোরান যথাযথ অনুসরণ করে, আল্লারূপী মহম্মদের অনুসারী হলে মানুষ অপরাধী হবেই হবে। কারণ ইসলাম শয়তান প্রবর্তিত ধর্ম। ধর্মের খোলস থেকে, বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে প্রকৃত সভ্য মানুষ হোক বাঙালি মুসলমান।

ওইমেন চ্যাপ্টারের প্রায় প্রতিটা লেখাই আমি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ি। পছন্দ করার মতন অনেক লেখা থাকলেও অধিকাংশই একই দোষে দুষ্ট। কিন্তু এই লেখাটা? এর কোনো তুলনা হয়না। সবটা লেখা পড়ার পরে আমার চোখ একটা জায়গায় এসে স্থির হয়ে যায়। “না থাক। ওরা একদিন আরো বড়ো হবে, ওরাও মা হবে। হয়তো ওদের ছেলেও একদিন আমার মতো বসে বসে তার মায়ের কুৎসিত কৈশোরের কথা ভেবে আমার জন্য ঘৃণার থুতু জমাবে। আমি কারো মাকে অপমান করতে চাইনা, যেমন চাই না আমার মায়ের অপমান দেখতে।” — অসাধারণ!

ধন্যবাদ তুষার কান্তি সরকার । আমার লেখা আপনার ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম । কিন্তু আহত হলাম কারন আমি এখনো উইমেন চ্যাপ্টারে কোন দুষ্ট লেখা পাইনি । আর আপনি দুষ্ট লেখা বলতে কি বোঝালেন সেটাও ক্লিয়ার বুঝলাম না। তবে সবার সব লেখা বা মতামতের সাথে সবাই একমত হবে তেমন কোন কথা নেই । আমিও অনেকের লেখার সাথে একমত নাও হতে পারি । আলোচনা হোক । আপনি আপনার মতামত দিন। কিন্তু দুষ্ট বলাটা একটু দৃষ্টিকটু নয় কি ? আবারও ধন্যবাদ আপনাকে ।

Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.