‘রুচিহীন’ একজন মন্ত্রীকে ডাকারই প্রয়োজন কী!

কাজী রোকসানা রুমা: হঠাৎ করেই একটি শিরোনাম নজরে আসে, ‘বর্ষবরণে যৌন নিপীড়ন বিষয়ই না: শাজাহান খান’। আমি সবকিছু একটু দেরীতে বুঝতে পারি বলেই প্রথমে এই শিরোনামের একটি অর্থ ভেবে নিয়েছিলাম, সেটি এমন যে, মন্ত্রী মহোদয় বলতে চেয়েছেন যে, বর্ষবরণে এমন কোন বিষয় ঘটেনি।

Minister 1
বিডিনিউজ২৪ থেকে সংগৃহীত

সত্যি সত্যি ঐ শিরোনামের অর্থ যদি আমার ভাবনার মত হোতো তাহলেও খানিকটা শ্বান্তনা খুঁজে পেতাম এই বলে যে, আমাদের মাননীয় মন্ত্রী এটাকে বেমালুম অস্বীকার করলেন, উচ্চপর্যায়ের অনেক নেতাই যা হরহামেশা করে থাকেন। কিন্তু ভেতরের লেখাগুলো পড়ে রীতিমত ধাক্কা খেলাম। এতো, ঘটনা অস্বীকারের চেয়েও ভয়ংকর!

ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের কনফারেন্স রুমে নতুন ধারা নামে একটি সংগঠনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। অনুষ্ঠানে নারী দিবস উপলক্ষে নানা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১০ নারীকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। নারী দিবসে, নারীদের সম্মাননা এ পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু গতবছর পহেলা বৈশাখে টিএসসি চত্ত্বরে নারীদের প্রতি যৌন নির্যা্তনের ঘটনাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টার ঐ বক্তব্য নারী হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে আমাকে ব্যথিত করে, ভাবায় দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

‘‘জার্মানিতে খ্রিস্টীয় নতুন বছরের অনুষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশে এর চাইতে বেশি ঘটে। এর চেয়ে আরও মারাত্মক মারাত্মক ঘটনা ঘটে’।’’ অন্যদেশকে অনুকরণে উৎসাহিত করা হলে অন্য সব বিষয়েও একটু নজর দেয়া প্রয়োজন। যেটুকুতে আপনাদের স্বস্তি হবে, সুবিধা হবে শুধু সেটুকুর উদাহরণ দেবেন, সেটুকু গ্রহণ করতে বলবেন, বাকিটা সব ‘খারাপ’ উদাহরন হিসেবেই প্রতীয়মান হবে, এ কেমন পরিহাস!

উন্নত দেশে যখন বেকার ভাতা দেয়া হয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ অন্যান্য সুবিধা দেয়া হয় তখনতো কেউ বলেন না যে, সেটিও অবশ্য পালনীয় এদেশে? তবে নারীর উপর নির্যাতনকেই কেন শুধু বৈধতা দেয়ার এই চেষ্টা?

একবার এক বিশিষ্ট জনের সাক্ষাৎকার নিতে গেলে তিনি গল্পোচ্ছলে বলছিলেন, আমাদের দেশে অনেকেই আছেন তাদেরকে যেকোনো জায়গায় কথা বলার জন্য ডাকা হলে তাদের কিছু মুখস্ত কথা আছে তা সে যে ইস্যুই হোক তারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই মুখস্ত কথাগুলোই বলেন। আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোর সাথে জড়িত ব্যক্তিদেরও সেই একই অবস্থা।

Ruma Bot tolaমন্ত্রী মহোদয় সেদিন নাকি নারীর অগ্রগতির প্রতিবন্ধক হিসেবে মৌলবাদকে দায়ী করেছেন। আমি এবং আমরা প্রত্যেকেই একথা স্বীকার করে নিচ্ছি, পাশাপাশি এটিও বলছি, নীতিনির্ধারকরা যখন যৌন নির্যাতনকে অমন বক্তব্য দিয়ে বৈধতা দেন তখন সেটা প্রকারান্তরে মৌলবাদকেই সমর্থন করে। যারা তথাকথিত মৌলবাদের সাথে যুক্ত নন, কিন্তু মননে মৌলবাদ ধারণ করেন এমন বক্তব্য তাদেরকে বরং উৎসাহিতই করে।

এবছর বা প্রতিবছর টিএসসি বা অন্য কোন জায়গায় পহেলা বৈশাখ বা অন্য কোন জাতীয় আয়োজনে ‘এটি কোন বিষয়ই না’-তে উৎসাহিত হয়ে যদি এমন ঘটনা আরও ঘটতে থাকে, তবে মাননীয় মন্ত্রী কি এর দায় এড়াতে পারবেন?

আমাদের দেশে বড় আকাল পূজনীয় মানুষের। আমাদের সামনে খুব কম মানুষ আছেন যাদেরকে আমরা অনুকরণ করতে পারি। এমনই আকাল! কিন্তু রাষ্ট্র যখন সবার নিরাপত্তা দিতে বাধ্য, সেই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নীতিনির্ধারকরা যখন এমন বক্তব্য দেন, তখন আর তা ব্যক্তি পর্যায়ে থাকে না, তা সরকারের বক্তব্য বলেই প্রতীয়মান হয়। আমরা আজ অব্দি কখন কোথায় কতখানি মুখ খুলতে হবে সেটাই শিখলাম না। আমরা মুখ খুললেই যেহেতু দুর্গন্ধ বের হয়, কাজেই বুঝে শুনে মুখ খোলাই বাঞ্ছনীয়।
কেউ কেউ মুখ খুললে যেমন গন্ধ বের হয়, সেই ভয়েই বোধহয় কেউ কেউ কখনোই মুখ খোলেন না। নাহলে সেদিন যে ১০ জন নারীকে সম্মাননা দেয়া হয়েছিলো, তাদেরই উচিত ছিলো ঐ অনুষ্ঠান বর্জন করা, অথবা তাদের যে সম্মাননা দেয়া হয়েছে, তা ফিরিয়ে দেয়া। তারা কি এতোটাই লজ্জা পেয়েছিলেন যে কোন প্রতিবাদই করতে পারলেন না, নাকি এতোটাই ভয়?

আমরা কিন্তু লজ্জিত। ভীষণভাবে লজ্জিত। আপনারা কোনো প্রতিবাদ না করে আমাদের মাথা খানিকটা নিচু করে দিয়ছেন। যদিও আপনাদের এই আচরণ কোনভাবেই আমাদের কাছে অনুকরণীয় নয়। করবোও না। আজ আপনারা যে সম্মাননা পেলেন বা যার হাত থেকে নিলেন, কখনো আপনি বা আপনার কাছের কেউ নির্যাতিত হলেও তিনি কিন্তু একই কথা বলবেন, সেদিন মেনে নিতে পারবেন তো? ‘কালচারাল সাইলেন্স’ বলে একটা কথা আছে, তো আমরা সাইলেন্স হতে হতে তো বোবাই হোয়ে গেলাম।
আয়োজনে  সেদিন অনেক ‘বড় বড়’ প্রতিষ্ঠানের নারী প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন দেখলাম সংবাদে। যদি জানতে পারতাম সংবাদে হয়তো ছাপাতে ভুলে গেছে যে ঐ সকল নারী তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ঐ বক্তব্যের, মনটাই ভরে যেতো তবে।

আমি ঠিক জানিনা ঐ অনুষ্ঠানে কোন ১০ দশ নারীকে সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছে, তাদের ঐ সম্বর্ধনা থেকে যা কিছু প্রাপ্তি, আনুষ্ঠানিকভাবে সব ফেরত দেয়া উচিত। নারী দিবসে নারীদের সম্মান জানানোর অনুষ্ঠানে যখন একজন মন্ত্রী এমন কথা বলার রুচি রাখেন সেই অনুষ্ঠান বর্জন করা উচিত। আয়োজকরাও কি বুঝতে পারেননা যে কার রুচি কেমন, কাকে ডাকছি। প্রগতির(!?)ঝান্ডার লেবাস পড়া মানুষেরা খুবই ভয়ংকর।

শেয়ার করুন: