সেই নারীদের কথা বলছি প্রিয় প্রধানমন্ত্রীকে

হাসিনা আকতার নিগার: জীবনের পথটা চলতে গিয়ে এখন আর বলতে পারি না, আমি নারী না পুরুষ, লক্ষী পয়মন্ত না অপয়া?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ লেখা আপনার দৃষ্টি গোচরে পড়বে কিনা জানি না। তবে মনে হলো নারী দিবসে আপনাকে একটা চিঠি লিখি। আর দশজন নারীর মতো আপনিও একজন কন্যা-জায়া-জননী। জীবনের নানা বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন আপনি। আপনারও আছে সুখ স্মৃতি, সর্বস্ব হারানোর বেদনা , সন্তানের সফলতা আর সেইসাথে নিজের সংগ্রামী জীবনের সফলগাঁথা।

Hasina Nigarসমাজের একটা অংশের নারীদের নিয়ে এ লেখা। একজন কন্যা যখন জন্ম নেয়, তখন বলা হয় , ‘মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়েছে  ঘরে লক্ষী এসেছে।’ এ কথা দিয়ে জন্মের পরই মেয়েটিকে প্রতিনিয়ত যেন ভাগ্য পরীক্ষা দিতে হয়। বাবার কর্মজীবনে সফলতা থেকে শুরু করে ব্যর্থতা সবকিছু  যেন সে নিয়ন্ত্রণ করে। সবার অজান্তে  মেয়েটি  বড় হতে থাকে  সে লক্ষী না অপয়া এ শব্দ দুটি দিয়ে  ছক্কা খেলার মতো জীবন নিয়ে। এরপর  প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি তাকে শিখানো হয় জীবনে যাই হও না কেন তোমাকে সংসার সামলাতে হবে । স্বামী কে খুশি করতে হবে। সন্তানদের মানুষ করতে হবে। আর তাই সংসারের কাজ জানতে হবে সবার আগে। যতই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগুক  না কেনআমাদের সমাজে , পরিবার  থেকে  এ ধারনা আজো শেষ হয়ে যাই নি।

বয়সের সীমা ১৬ তে পড়তেই চিন্তা শুরু মেয়ের বিয়ে দিতে হবে। যত ভাবে স্বামীর ঘরে মেয়েকে সুখী করা যায় তার চেষ্টা  থাকে মেয়ের পরিবারের।  বিয়ের পর স্বামীর ঘরে  পা দিতেই শুনতে হয়ে জন্মের  পরের সে কথাটি ‘ বউ ঘরে লক্ষী নিয়ে আসবে।’ এবারের ভাগ্যে পরীক্ষাটা অনেক বেশী কঠিন। কারণ মেযেটি বুঝে উনিশ থেকে বিশ হলেই তাকে শুনতে হবে সব দোষ তার, সে অপয়া।

হয়ত কেউ কেউ বলবে এসব এখন অচল কথা। সেটা বলে সাধুবাদ পেতে পারে কিন্তু নারী জীবনের এ এক নির্মম বাস্তবতা। জীবনটা যেন সাপ লুডু খেলা  হয়ে যায়।

একদিন হয়ত সে নারী আপন ভাগ্যকে নিয়তির বিধান মনে করে ঘর ছাড়ে। শুরু হয় জীবনের আরেক গল্প। এমন হাজারো গল্পময় জীবনের নারীদের কথা কেউ জানে না। তারা কি করে  আর্থ সামজিক ব্যবস্থার সাথে লড়াই করে সন্তান মানুষ করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে। তাদের  জীবনের হতাশা-বিষন্নতা শুধুই তার।

এ সমাজে ঘর ছাড়া নারীকে কোন যাচাই বাছাই ছাড়া শুনতে হয়, ‘ঘর যখন ছেড়েছে দোষ তার।’ আর আইনি প্রক্রিয়াতে সংসার বিচ্ছেদের প্রাপ্তিটুকু নারী এবং সন্তানরা তেমন করে পায় না। কারণ সেখানে রয়েছে নানা দুর্বলতা।  
নারী দিবস এলেই সবার মুখে নারীদের উচ্ছসিত কথা সকল স্থানে। নারী পুরুষের কোন বৈষম্য আর থাকবে না সে নিয়ে সেমিনার সভা সমাবেশ কত কি।

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আজ আপনাকে সেই নারীদের কথা বলছি। যারা জীবনের সংগ্রামটা একা করছে তাদের জন্য কি কিছুই করার নেই এ রাষ্ট্রের? একজন একা নারী কাজের ক্ষেত্র থেকে সকল স্থানে নানাভাবে বিব্রত হয়। মাঝে মাঝে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হয় যেন স্বামীবিহীন একজন নারী হওয়াটা জীবনের চরম অপরাধ।

কিন্তু কেন এমন হবে? কোন কাজের ক্ষেত্রে সবার আগে স্বামীর পরিচয় টাই মুখ্য হয়ে যায়। অথচ একজন পুরুষকে কেউ কোন দিন প্রশ্ন করে না তার স্ত্রী কী করে? তার নাম কী?

তারপর দেখা যায় বিপরীত পরিবেশ যখন সে নারী জীবন চালায়, তখনও প্রশ্ন উঠে। এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আহত হয় তার সন্তানটি। যার প্রভাবে হয়তোবা সে সন্তানটি বিপথগামী হয়ে যায়। একজন সংগ্রামী মায়ের সন্তান যদি সুস্থভাবে বড় না হয় তবে সেটা তার জীবনের সকল প্রচেষ্টাকে অসাড় করে দেয়।
বেঁচে থাকার লড়াই করতে করতে নারীটি ভুলে যায় সে কি নারী না পুরুষ। কারণ আত্মিকভাবে সে একজন মানুষ হয়ে তার দায়িত্ব সব পালন করে। সন্তানের কাছে সে একই সাথে বাবা এবং মা। অপরজনের অনুপস্থিতি বুঝতে না দেয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালাতে গিয়ে সেই মা’টির আপন কোন সত্ত্বা আর থাকে না। জীবনের ভালোবাসার গল্পগুলোও একসময় ফিকে হয়ে যায়।
আবার এমন নারীদের অনেকের নিজেদের সফলতা বা সন্তানের সফলতার অন্তরালের অশ্রুটুকু কেউ জানে না।

দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নয়। একজন নারী  হিসাবে এমন নারীদের নিয়ে একবার ভাববেন আপনার কোন অবসরে এই প্রত্যাশাটা  সকল একা সংগ্রামী জীবনের নারীদের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি রইলো।

এমন হাজারো নারীর জীবনে রয়েছে সংসার আর সন্তানদের সফলতা কিংবা ব্যর্থতার কাহিনী। জীবনের চাহিদার কাছে সন্তানকে নিয়ে তাদের  কারো কারো  স্বপ্ন হয়ত পূরন হয় না দৈন্যতার কারণে বা  নিজের জীবনের সবটুকু বির্সজন দিয়ে লড়াই করে সমাজে টিকে থাকে নীরবে নিভৃতে।

তবু তারা নারী নয়, একজন মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যায় নিরন্তর। সে নারী বা পুরুষ তা যেমন মূল বিষয় নয়, তেমনি নারী লক্ষী না অপয়া তা বড় গৌণ হয়ে যায় জীবনে। জীবন যুদ্ধটাই তখন মুখ্য এবং তার একার।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.