নারীমুক্তি কোন পথে

মন্টি বৈষ্ণব: নারীমুক্তি ব্যতীত মানবমুক্তির সংগ্রাম বিজয়ী হতে পারে না। তেমনিভাবে, মানবমুক্তি ব্যতিত নারী সমাজের মুক্তি সাধনও সম্ভব হতে পারে না। সেকারণে বলা যায় যে, সকল প্রকার বৈষম্য ও শ্রেণি শোষণের বিরুদ্ধে মানবমুক্তির সংগ্রামের সঙ্গে নারীমুক্তির সংগ্রাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারীমুক্তির সংগ্রাম তাই কেবল নারীর নয়, সকল শোষিত মানুষের। গণতন্ত্র, প্রগতি ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামকে অগ্রসর করার জন্যে নারীমুক্তির সংগ্রামকে বেগবান করতে হবে।

8 March 2৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৮৫৭ সালের মার্চ মাসে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে সেলাইকলের হাজার হাজার নারী শ্রমিক ন্যায্য মজুরি, দশ ঘণ্টা কাজ, উন্নত কর্ম পরিবেশ ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের দাবিতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলনরত বহু নারীশ্রমিক পুলিশের নির্মম অত্যাচারের শিকার হন এবং গ্রেফতারবরণ করেন।

১৮৬০ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরের কারখানার নারী শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ের লক্ষে নিজস্ব ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে সমর্থ হন। ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আবার নিউইয়র্ক শহরের পূর্বপ্রান্তে হাজার হাজার নারী দর্জি শ্রমিক তাদের ভোটাধিকারসহ বিভিন্ন দাবিতে বিশাল এক প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন। ইতিহাসে যা ‘বিশ হাজারির উত্থান’ (আপরাইজিং অব টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড) নামে খ্যাত। নারী শ্রমিকদের এ সংগ্রামকে স্মারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন বিপ্লবী ক্লারা জেটকিন। তাঁর প্রস্তাবনা ও উদ্যোগেই ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

১৮৪৮ সালে প্রকাশিত কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে ব্যাখ্যা করা হয় যে, কী কারণে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সর্বহারা শ্রেণিই নারী জাতির প্রকৃত মুক্তির জন্য একনিষ্ঠভাবে সংগ্রাম করতে সক্ষম। ১৮৬৮ সালে শ্রমিক শ্রেণির প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কার্ল মার্কস নারীর অধিকারের প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন। তার প্রচেষ্টায় প্রথম আন্তর্জাতিকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়নগুলিতে পুরুষের সঙ্গে নারী শ্রমিকদেরও সভ্যপদ দেয়া হতে থাকে। ১৮৭১ সালে প্যারী বিপ্লবে নারীদের ভূমিকা ঐতিহাসিক এবং অবিস্মরণীয়। কার্ল মার্কস লিখেছেন- ‘প্যারীর রমণীগণ মহৎ একনিষ্ঠ রূপে বিপ্লবের পুরোভাগে এগিয়ে এসেছেন। প্যারীর নারীরা ব্যারিকেড ও বধ্যভূমিতে প্রফুল্ল মনে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।’ ১৯৮৯ সালে প্যারী শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে কমউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন সর্বপ্রথম সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের দাবি উত্থাপন করেন। এরপর থেকেই ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স সর্বত্রই নারী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে।

মানুষের প্রতি অগাধ ভালবাসা, বুদ্ধিমত্তা, সাংগঠনিক দক্ষতা থেকে ক্লারা জেটকিন ১৮৭৪ সালের দিকে জার্মানির নারী আন্দোলন ও শ্রম আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলনে জার্মানির কমিউনিস্ট নেত্রী কমরেড ক্লারা জেটকিন বছরের যেকোন একটি দিনকে নারীদের ভোটাধিকার দাবি দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করেন।

১৯১১ সালের ১৯ মার্চ দিনটি সর্র্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস রূপে পালিত হয় এবং তারপর থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী নারীরা মার্চ মাসের বিভিন্ন দিনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু করেন। অবশেষে ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের নারী দর্জি শ্রমিকদের ঐতিহাসিক ভোটাধিকার আন্দোলনকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯১৪ সাল থেকে ৮ মার্চ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। পরবর্তীতে শুধুমাত্র শ্রমজীবী নারীদের সমঅধিকারের দাবিই নয়, নারীমুক্তির প্রতীক দিবস হিসেবেও এ দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

এরপর থেকে প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিলে, কমিউনিস্ট ও বামপন্থিরা ছাড়াও সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন মতের মানুষ এ দিবসটি পালন করা শুরু করে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের রয়েছে ঐতিহাসিক তাৎপর্য। মানুষ হিসেবে একজন নারী তার পরিপূর্ণ অধিকারের দাবিতে সুদীর্ঘকাল আন্দোলন চালিয়ে আসছে। অথচ নারীরাই সব দেশে সবার চেয়ে পিছিয়ে আছে। পৃথিবীতে নারী-পুরুষের সংখ্যানুপাত প্রায় সমান। সমাজ একসময় মাতৃতান্ত্রিক ছিল। সে সময় নারীরা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করতো। ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ এবং হেনরি লুই মরগানের ‘আদিম সমাজসহ আরো বিভিন্ন গ্রন্থে এ ব্যাপারে আলোচনা দেখা যায়। মর্গানের মতে, নারী-পুরুষ দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে এক পর্যায়ে পরিবার বিকশিত হয়েছে।

আদিম যুগে দেখা যায়, নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বিধি নিষেধ ছিল না। এ কারণে, সন্তানের পিতৃ পরিচয়ও ছিল না। সে সময় কৃষিকাজ নিয়ন্ত্রণ করতো নারীরা। সন্তান জন্ম ও লালনের জন্য পুরুষের সাথে নারী শিকারে যাওয়া থেকে বিরত থাকতো। কৃষিকাজ মানব ইতিহাসে নারীর হাত ধরে বিকশিত হয়েছে। মার্কস এবং এঙ্গেলস বলছেন, মানুষের ইতিহাসে নারী এবং পুরুষের কাজের পরিধিকে কেন্দ্র করে প্রথম শ্রম বিভাজনের সূত্রপাত হয়। প্রথম শ্রেণি নিপীড়নের সূচনাও নারী এবং পুরুষের মধ্যে ঘটে। উৎপাদন কর্মকাণ্ডের ভার পুরুষের হস্তগত হওয়ার মাধ্যমে নারীর পরাজয় সূচিত হয়।

Monty Boishnab
মন্টি বৈষ্ণব

মার্কসীয় নারীবাদের আন্দোলন পুরুষদের বিরুদ্ধে নয়। এ ধারার আন্দোলনের প্রধান কর্মসূচি হচ্ছে, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উচ্ছেদ করা। মার্কসবাদীদের মতে, কেবলমাত্র এ প্রক্রিয়ায়ই নারীর পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জন সম্ভব। কার্ল মার্কস, ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, ক্লারা জেটকিন, ভøাদিমির লেনিন, আলেকজান্ডার কোলনতাই প্রমুখ মার্কসবাদীরা নারীবাদকে শক্তিশালী অবয়ব দেন।

তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেরূপ পরিপূর্ণ নারীমুক্তি কোন পথে সম্ভব? বিপরীতে যেতে হলেও এ প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়ার জন্য ভাবতে হবে। ভাবতে হবে মুক্ত মনে। মার্কসীয় তত্ত্ব প্রকাশের পূর্বকাল থেকেই নারীদের সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করা হতো যে, নারীরা চিরকাল পরাধীন ছিল এবং থাকবে। নারী জাতির পরাধীনতা ও সামাজিক বৈষম্যের মূল অর্থনৈতিক উৎসটির কথা ঊনবিংশ শতাব্দিতে সর্বপ্রথম মার্কস-এঙ্গেলসই তুলে ধরেন।

মার্কসবাদী তত্ত্ব দেখিয়ে দিয়েছে যে, সমাজে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সূচনা বা শ্রেণি শোষণের সূচনা থেকেই নারীর পরধীনতা ও দাসত্ব শুরু হয়েছে। নারীর পরাধীনতার মূলে আছে নারীকে সমাজিক উৎপাদনের কাজ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘরকন্যার কাজে আটকে রাখা এবং অর্থনৈতিক পরাধীনতার দাসত্ব-শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলা। তাই নারীর সামাজিক মুক্তির প্রথম উপায় হচ্ছে সামাজিক উৎপাদনের সঙ্গে নারীদের যুক্ত করা। নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করা ও সেজন্য সমাজ ব্যবস্থার আমূল বিপ্লবী পরিবর্তন ব্যতিত এ কাজ পরিপূর্ণ রূপে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।

নারীমুক্তি কেবলমাত্র তখনই সম্ভব হবে যখন সামাজিক, অর্থনৈতিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নারীরা অংশগ্রহণ করবে। কেবলমাত্র তেমন অবস্থাতেই নারীরা সমাজে পুরুষের সমান স্থান পাবে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সৃষ্টিশীল সত্তা বিকাশের প্রশ্নে নারীকে দ্বৈত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামে নামতে হয়। শ্রমিক হিসেবে তার লড়াই পুঁজির বিরুদ্ধে এবং নারী হিসেবে লড়াই পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে।

তবে পুরুষতান্ত্রিকতা ও পুঁজির শ্রমদাসত্ব থেকে নারীমুক্তির এই লড়াই শুধুমাত্র কারখানাভিত্তিক কিছু অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায় কিংবা পুরুষতান্ত্রিকতা বিরোধী কিছু নারীবাদী শ্লোগানের মধ্যে আবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং মানুষ হিসেবে নারীমুক্তির এই লড়াইয়ের আঘাত পরিচালনা করতে হবে গোটা পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তাই একদিকে পুঁজির শোষণ অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের শোষণের দাসত্ব থেকে গোটা সমাজকে মুক্ত করতে না পারলে নারীর প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়। এ সংগ্রাম আসলে ‘মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ’ নির্মাণ, তথা সাম্যবাদী সভ্যতা নির্মাণের জন্য সংগ্রামের সাথে সমার্থক।

নারী দিবসের তাৎপর্যকে আড়াল করার জন্য আমাদের দেশসহ দুনিয়ার দেশে দেশে শোষক শ্রেণি এনজিও, কর্পোরেট পুঁজির নানা উৎসব আয়োজন ইত্যাদি নানা অপ্রয়াসের আশ্রয় নেয়। আমাদের দেশে ও বিশ্বের অনেক দেশে এনজিও ও বহুজাতিক কোম্পানি বা বিভিন্ন দাতা গোষ্ঠীর নারী উন্নয়ন বা জেন্ডার ডেভলপমেন্ট নিয়ে যেসব ভাওতাবাজি মার্কা কাজ চলছে তা তারা করছে নারীকে মূলত পরাধীন করে শোষণের বেড়াজালের ভেতর আটক রাখার গোপন কৌশল হিসেবেই। এনজিও’র মাধ্যমে পরিচালিত প্রজেক্টভিত্তিক নারী উন্নয়নমূলক সংস্কারধর্মী কাজের দ্বারা প্রকৃত নারীমুক্তি সম্ভব নয়। রাজনৈতিক লক্ষ্যবিহীন এসব কর্মসূচি পালনে তেমন কোনো লক্ষ্য সাধিত হয় না।

নারীর প্রতি সকল প্রকার শোষণ-বৈষম্য-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি লড়াই করছে। এই লড়াই যেমন নারীর প্রকৃত মুক্তির লক্ষ্যে সমাজতন্ত্র অভিমুখী, তেমনি বিদ্যমান ব্যবস্থায় নারীর সর্বোচ্চ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত। নারীমুক্তি হবে তখনই- যখন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। নারীমুক্তির ঝাণ্ডা ও কাস্তে-হাতুরিখচিত সমাজতন্ত্রের লাল ঝাণ্ডা- এই উভয় ঝাণ্ডাকে একসাথে উড্ডীন রেখে এগিয়ে যেতে হবে মুক্তির পথে।

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.