ফারহানা হাফিজ: ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। দিবসটিকে সামনে রেখে মিডিয়ার সকল মাধ্যম তো বটেই, সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন সংগঠন থেকে শুরু করে কর্পোরেট হাউসগুলোও ব্যস্ত থাকবে বিভিন্ন আয়োজনে। কারো কারো আয়োজন হয়ে উঠবে প্রতিবাদের কন্ঠস্বর, কারো কারো আয়োজনে উঠে আসবে নারীর পথচলার সাফল্যের কথা, কারো আয়োজন বা হয়তো দিনশেষে অন্যান্য দিবস পালনের মতো একটি উপলক্ষ হবে যার উদ্দেশ্য হবে বেগুনি/গোলাপী শাড়ী বা ঐ রঙের ড্রেসকোডে সজ্জিত হয়ে কোন রেস্তোরায় ‘চেক ইন’ এর স্ট্যাটাস জানানো।
শেষোক্ত উদযাপনের ঢংটি যেহেতু কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসনের পরিণাম, এবং যার সাথে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল সুরের সাংঘর্ষিকতা আছে, সেহেতু ওটি আমার লেখার মূল বিবেচ্য নয়।
চলুন, তাহলে নারী দিবসের দিনে আমরা একটু মিলিয়ে দেখি আমাদের কী কী অর্জন হলো?
শুরুতেই আমাদের মনে করা উচিত কী দাবীতে প্রথম ১৮৫৭ সালে ও পরে ১৯০৮ সালে ৮ মার্চ আমেরিকার শ্রমিক নারীদের ইউনিয়ন বিক্ষোভ করেছিল, যার প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বে নারী দিবস পালিত হয়। কী ছিল সেই দাবি?
অনেক দাবীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তিনটি দাবি।
১. ভোটের অধিকার, যা নারীর রাজনৈতিক অধিকার, তা হতে পারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াতে নারীর অংশগ্রহণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ।
২. কারখানায় শ্রমিক নারীদের জন্য দৈনিক নির্দিষ্ট কর্মঘন্টার ব্যবস্থা করা, যা কারখানায় নারীর শ্রমকে বা নারীকে শ্রমিক হিসেবে একটি আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাবে।
৩. নারীকে পুরুষের সমান মজুরী প্রদান, যা নারীর সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনের দাবি।
এই তিনটি দাবিকে ভিত্তি করেই যদি ‘বাংলাদেশে নারীদের অবস্থাটা’ কে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে আমাদের অর্জনটা কী?
১. নারীর ভোটাধিকার, নারীর রাজনৈতিক অধিকার: বাংলাদেশের নারীদের ভোটের অধিকার অর্জিত হয়েছে অনেক আগেই। বাংলাদেশের ভোট রাজনীতিতে নারীর ভোট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে। এমনকি নির্বাচনে অংশগ্রহণের দিক থেকেও নারীরা এগিয়েছে, বিশেষ করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায়। জাতীয় সংসদেও নারীর সংখ্যা বেড়েছে বিগত বছরগুলোতে। কিন্ত আমার বিশ্লেষণের বিষয় সংখ্যা নিয়ে নয়, বরং গুণগত কিছু বিষয় নিয়েই বিশ্লেষণটি এগোবে।
আসুন সংখ্যার মারপ্যাচে না গিয়ে অন্যভাবে সমীকরণটা করি। তার জন্য কিছু প্রশ্ন সামনে আনছি। আচ্ছা বলুন তো এই যে আমরা নারীরা ভোট দেই, বা ভোটের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করি, তার কতটুকু একেবারে নিজের রাজনৈতিক সচেতনাপ্রণোদিত পছন্দ থেকে আর কতটুকু পারিবারিক পছন্দের ভিত্তিতে।
যদি ধরেও নেই নারী নিজ রাজনৈতিক জ্ঞানের ভিত্তিতেই এই রাজনৈতিক অধিকারটা প্রয়োগ করে, তাহলেও কিন্ত প্রশ্ন থেকে যায় যে সেটি কতটা নারী অধিকার সচেতন বা আদৌ সচেতন কিনা? কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো কতটা নারী অধিকার সচেতন, সেটা কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। খুলে বললে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ আর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মধ্যে দিয়ে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অংশগ্রহণ এক কথা নয়।
যদি হতো তাহলে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা নিয়ে ২০০৭ পরবর্তী সময়ে যে হীন রাজনৈতিক খেলা দেখলাম বা এখনও দেখে আসছি তা হবার তো কাথা নয়।
বা আজও কেন সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন বাংলাদেশ দিতে পারলোনা, যা নারীর সম্পত্তিতে সম অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে এখনও কাঁটা হয়ে আছে। লেখার এই অংশটি শুরু করেছিলাম নারী ভোটাধিকার নিয়ে। সে প্রসঙ্গে আবারও একটি প্রশ্ন রাখছি, ভোট যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে আমার পছন্দের ব্যক্তি নির্বাচন করা হয়, যা গণতান্ত্রিক অধিকারও বটে, তাহলে নারী সেই গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা কি আমাদের পরিবারগুলোতে আছে?
ভেবে দেখুন তো পরিবারের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেবার সর্বময় অধিকারী কে? আদৌ কি পরিবারগুলোতে কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে যেখানে পারিবারিক ছোট বড় সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে নারী নিজের সচেতনতায়, নিজের পছন্দে নিজের মতামতটি দিতে পারে?
আমরা জানি স্বীকার করতে চাই বা না চাই এর উত্তরটা আমাদের জানা এবং তা মোটেও আশার বাণী শোনায় না। যদি পরিবারগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীকে আমরা কাম্য ভূমিকার পেতাম, তাহলে পান থেকে চুন খসার অজুহাতে পরিবারের মধ্যে নারী নির্যাতনের শারীরিক হার ৬৭% হতনা।
২. নারীর নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা: নারীর কর্মঘন্টা আসলে কত? এই হিসেবটি কখনও সঠিক হবেনা, যদি না আমরা পরিবারের মধ্যে নারীর শ্রমকে হিসেবে ধরি। বলবেন, পরিবারে নারীর আবার শ্রম কি? ‘ বাসায় বসে নারীরা আবার কোন কাজ করে কি?’ আমাদের নারীরা যে বিপুল সময় ‘কেয়ার গিভার’ হিসেবে পরিবারের মধ্যে ব্যয় করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে, তার স্বীকৃতি কি আনুষ্ঠানিকভাবে আছে? তার মানে নারীর কর্মঘন্টা টি অতি দীর্ঘ হওয়া সত্ত্বেও পরিবারের মধ্যে নারীর যে বিরাট কর্মযজ্ঞ তার কোন অবদানের কোন মূল্যায়ন নেই। এটা লিখতেই মনে হলো নারী যে ঘরের বাইরে যে কোন কাজেই হোক অবদান রাখে, তার কতটুকু মূল্যায়ন পরিবারে হয় বা আদৌ হয় কি? মূল্য বিনে কি কর্মঘন্টার হিসেবটি মেলানো যাবে, না উচিত হবে, তা ভাবতে হবে।
৩. সমান মজুরী, সমান অধিকার: শ্রমিক বা দিনমজুর হিসেবে নারীর বিচরণ যে সকল ক্ষেত্রে, যেমন, গার্মেন্টস্, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর মজুরী কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের তুলনায় কম। চাকুরী ক্ষেত্রেও বিশেষ করে বেসরকারী ক্ষেত্রে কখনও কখনও একই পজিশনে নারীকে কম পারিশ্রমিক দেয়া হয় কম অভিজ্ঞতা বা কম দক্ষতার অজুহাতে, যা কিনা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবনা প্রসূত কাল্পনিক চিন্তার ফলাফল।
যদি এই হয় নারীর বাস্তবতা, তাহলে সমীকরণটা দাঁড়ালো কি? আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো এমন: শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দিকে দিকে বিভিন্ন অভিমূখে নারীর জয়যাত্রা, তা কারও দানে বা ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতার কল্যানে পাওয়া নয়। এটি যুগে যুগে নারীর লড়াই করার যে নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা, তার উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, হচ্ছে, হবেও।
খোলাসা করেই বলি। এই যে প্রায়ই শুনতে হয়, ‘নারীরা অনেক এগিয়েছে, আপনারা আর কত এগোতে চান?’, উত্তরটা হলো ‘এগিয়েছি যতোটাই, আরো ততটাই এগোবো, যা আমাকে সমতার পাল্লাতে এক অবস্থানে আনে, আর সেই মাপটা যতক্ষণ আমারই জ্ঞানে ও সচেতনতায় সমান ঠেকে, অন্য কারো মাপে নয়’।
আসুন এই লেখাটা আপাতত শেষ করি, যদিও আলোচনাটা চলবেই। লেখাটির শিরোণামে প্রশ্নটা রেখেছিলাম। লেখার শুরুতে নারী দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে যে ৩ টি দাবীর ভিত্তিতে আলোচনাটি চলছিল, তার সমীকরণ মেলালে দেখতে পাই নারীর সরব উপস্থিতি ও অবদান আজ সর্বোত্র বিরাজমান। তাই যখন প্রশ্ন করি ‘আর কতটা?’, তখন আমাদের থেমে না গিয়ে প্রথমত পাল্টা প্রশ্ন রাখতে হবে ‘নারী তো তার সমাজসৃস্ট দায়িত্ব ব্যতিরেকেও ( শুধুমাত্র ঘর কন্যার দায়িত্ব) সকল ক্ষেত্রেই অবদান রাখছে, তার সঠিক মুল্যবান কি হয়, না আমরা সবাই তার যোগ্যতা রাখি?’। তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন নারীর অবদানকে স্বীকৃতিস্বরূপ নারীর এই জয়যাত্রাকে উদযাপন করতে হবে, তা অবশ্যই নারীর সম অধিকারের ঢঙে, কর্পোরেট ঢঙে নয়।
দ্বিতীয়ত, যে প্রতিবাদী কন্ঠস্বরটি চালু রাখতে হবে বছরব্যাপী নানা আয়োজনে, তা হলো : নারীদেরকে ‘দ্বিতীয় নাগরিক’ হিসেবে দেখার যে পিতৃতান্ত্রিক আদর্শ, যে আদর্শ নারীকে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রের, কর্মক্ষেত্রে পুরুষের অধস্তন হিসেবে দেখার মানসিকতা তৈরী করে, সেই আদর্শের বিপরীতে ‘সমতা ভিত্তিক’ আদর্শের ভিত্তি তৈরী করাটা জরুরী। আর ভিত্তিটা শুরু করবো নিজের পরিবার থেকেই। অবশ্যই বিশ্বাস রাখতে হবে, সমতাভিত্তিক মর্যাদার বুনিয়াদ যত শক্ত হবে, ততটাই ‘আর কত অধিকার চান” এ ধরনের প্রশ্ন করার মানসিক প্রবণতা কমবে।
সর্বশেষে শিরোনামের প্রশ্নটার উত্তর খুব সংক্ষিপ্ত’ পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারী পুরুষের মধ্যকার সম-মর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত অধিকার অর্জনের আওয়াজ তুলেই যাবো।’
An excellent write up. This article critically dissected the corporatization of women’s moment and empowerment struggle. Women’s fight is not only for equality among men and women, women’s fight for equality is universal struggle and fight for equality. Farhana wrote about political empowerment. Unfortunately the birthplace of movement for equality could not get a women president till now though USA proudly showcase their democracy to the world as a model. Requesting more articles from the writer Farhana.