শাশ্বতী বিপ্লব: কর্মজীবী নারীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নারী দিবস ঘোষিত হলেও কর্মজীবী নারীর মুক্তি মেলেনি আজও।ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে নারী অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখে, তাকে আবার ঘরের চারদেয়ালে বেঁধে ফেলার চেষ্টা চলে অবিরাম। সংসারের সকল অনিয়মের দায় এই নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে বাকিরা দায়মুক্তি খোঁজে।
সংসার টিকছে না, দোষ কর্মজীবী স্ত্রীর। সন্তান লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ছে, মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে বা অসৎসঙ্গে পড়েছে, দোষ কর্মজীবী মায়ের। শাশুড়ীর সাথে বনিবনার অভাব, দোষ কর্মজীবী বউয়ের। সময় অসময় মুখরোচক খাবার জোটে না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, দোষ সেই একই। অফিসে ওভারটাইম করতে চান না, যৌন হয়রানীর শিকার বা আপনি সন্তান সম্ভবা? – আপনি বাইরে কি করেন, আপনার জায়গাতো ঘরে!!
এমনি শত শত অভিযোগের আঙ্গুল তুলে থাকা এই সমাজ কর্মজীবী নারীদের হাসিমাখা মুখগুলোর আড়ালে কত ক্লান্তি লুকানো থাকে সে খবর রাখে না। ঘুমের কোটা না পুরণের ক্লান্তি, মাতৃত্বের ক্লান্তি, স্ত্রীর দায়িত্ব পালনের ক্লান্তি । তবে সবচেয়ে বেশি ক্লান্ত করে বুঝি জল্লায় পা দেয়ার নিরন্তর সাবধানতা। সারাক্ষণ ছড়ি হাতে সদা জাগ্রত এই সমাজ কর্মজীবী নারীর “না পারার” খোঁজ রাখতে যতটা আগ্রহী, নারীদের মেধা, শ্রম ও আয় থেকে কখন কোথায় কিভাবে উপকৃত হয় সেই সত্যটা মানতে ততটাই নারাজ।
“সারাদিন হাঁড়ভাঙ্গা খাটুনির শেষে ঘরে ফিরে দেখবে কেউ অপেক্ষা করে আছে”-এই রোমান্টসিজম থেকে পুরুষ আজও বের হতে পারেনি। এই রোমান্টিসিজম অপরাধ নয়। কিন্তু এটা কেবল পুরুষের জন্য তোলা থাকাটা অপরাধ। এক্ষত্রে নারী দাতা, পুরুষ গ্রহিতা। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে আজও গৃহকর্মে নিপূণা, সন্তান লালন-পালন আদর্শ নারীর মাপকাঠি। কাজ শেষে তড়িঘড়ি করে ঘরে ফেরার দায় নারীর যতটা, পুরুষের ততটা নয়। সন্তানেরা সারাদিন মায়ের পথ চেয়ে বসে থাকে, বাবার নয়!! এনিয়ে নারীর প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। তাই সংসারের যেকোন অনিয়মে চাকরি ছেড়ে দেয়ার প্রশ্ন ওঠে নারীর, পুরুষের নয়।
অর্থনৈতিক কারণে কেউ কেউ নারীর বাইরের কাজটা মেনে নিলেও, নারীর স্বাধীনতার লাটাইটা পুরুষের হাতেই ধরা থাকে। নারীর ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবা নিষেধ, কর্মক্ষেত্রে বন্ধু বানানো নিষেধ, কাজ শেষে অন্য কোথাও যেতে চাইলে তার বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। পুরুষ এইক্ষেত্রে স্বাধীন। একটু ফোন টিপে জানিয়ে দিলেই হয় আজ ফিরতে দেরি হবে, ব্যাস। অনেকে তারও ধার ধারেন না।
কর্মজীবী নারীর প্রধান অপরাধ বোধকরি পুরুষের খাটুনি ও মেধা সম্পর্কে ধারণা করতে পারা। পুরুষের “সারাদিন অফিসে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি”-র সঠিক চেহারাটা বহুদিন পর্যন্ত সত্যিই অজানা ছিল নারীর। গৃহস্থালীর কাজের বাইরে জগতটা কিভাবে চলে সেটা যেদিন নারী বুঝতে শুরু করেছে সেদিন থেকে পুরুষের জারিজুরিও ফাঁস হতে শুরু করেছে।
কাজের বাইরেও আর কী কী করে পুরুষ সময় কাটায় সে সম্পর্কে নারী যখন আন্দাজ করতে পারে এবং সেগুলো নিয়ে একপর্যায়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে তখনই আসল বিপর্যয় তৈরি হয়। বাইরের ব্যাপারে পুরুষের উপর নির্ভরশীলতা, সিদ্ধান্ত নেয়ার একছত্র অধিকার, কিংবা যেকোনো আলোচনাতে “তুমি বুঝবে না”, “যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না” টাইপের হামবড়াভাব দেখিয়ে যখনই নারী অস্বীকার করা শুরু করেছে তখনই তার চিরচেনা মানুষটি আর চেনা থাকেনি।
পুরুষও কেন সন্তান পালনসহ গৃহস্থালীর অন্যান্য কাজে হাত লাগাবে না, বা নারীও কেন একইরকমভাবে অবসর সময় কাটানোর সুযোগ পাবে না – এই প্রশ্ন তোলাটাই নারীর কাল হয়েছে। প্রচলিত ধারণার ঘরকন্না বা সেবা দিতে নারী যখনই ব্যর্থ হয়, তখনই ভাঙ্গনের আওয়াজ ওঠে।
কর্মক্ষেত্রে যেমন তেমন, গৃহে নারীর আত্মসম্মানবোধ থাকতে নেই। সেখানে সে সবসময়ই অধস্তন। সুখের সংসার গড়ার দায়িত্ব বা সংসার টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আজও যতটা নারীর, ততটা পুরুষের নয়। “সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে” বাণীটি আজও সমানভাবে সমাদৃত।
পুরুষের আশৈশব লালিত আদর্শ ও মূল্যবোধ পুরুষকে নারীর সমকক্ষ ভাবতে বাধা দেয়। স্ত্রীর যোগ্যতা তার অহমিকাকে আহত করে। কর্মজীবী নারীর স্বামীকে কখনও না কখনো পরিবার বা বন্ধুমহলের কটুক্তির শিকার হতে হয়। কোন পুরুষ তার স্ত্রীর কাজকে সম্মান করলে বা মতামতকে গুরুত্ব দিলে এখনও বন্ধু সমাজে তাকে নিয়ে হাসাহাসি চলে। তারা পুরুষকে ভাবতে বাধ্য করে সে কতটা অবহেলিত কিংবা স্ত্রৈণ। এই আলোচনা বা কটাক্ষ পুরুষের অহমিকাকে আহত করে। নারী দিবস ঘোষণার ১০৬ বছর পরও তাই এই আলোচনা এখনও প্রাসঙ্গিক।
কর্মজীবী নারীর যতো অপরাধ
শেয়ার করুন: