শবনম নাদিয়া: প্রায়ই একটা কথা শুনি –নারীপুরুষ উভয়ের মুখেই। যারা বলেন তারা ভালো ভেবেই বলেন। কথাটার ধরনটা এমন যে নারী প্রতিবাদ করলেই সমাজের লিঙ্গজনিত বৈষম্য দূর করা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস–অনেকেই নারীর প্রতি বৈষম্য এবং অনাচার সংক্রান্ত পোস্ট করছেন ফেসবুকে; আজকে সকাল থেকেই এতোবার দেখছি নারীরা প্রতিবাদ করলেই, স্বাবলম্বী হলেই, নিজেদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল হলেই সব বৈষম্য দূর হবে জাতীয় পোস্ট, তা বলার মতো না।

কথাটা খানিক সত্য। অধিকার সংক্রান্ত সচেতনতা এবং প্রতিবাদ বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয়। কিন্তু এই অতি প্রচলিত সাধারণ আবেগ, যে নারীর প্রতিবাদের এবং অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার অভাব মোচন করতে পারলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, তা কিছু রূঢ় সত্যকে দেখেও না দেখার ভান করে।
আজকেই অনলাইন পোর্টাল উইমেন চ্যাপ্টারের একটি নিউজে এরকম একটি কঠিন সত্যের মুখোমুখি হওয়া গেল পারিবারিক সম্পদের ক্ষেত্রে, সে পরিবার জন্মগত হোক, বা বৈবাহিক হোক, মেয়েদের অধিকার নিতান্তই নগণ্য। অর্থনৈতিক বৈষম্যের এই পারিবারিক অংশটির প্রশ্নে আলাপ করতে গিয়ে দেখেছি, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই যে মেয়ে পারিবারিক সম্পদে সমানভাগ দাবি করেছে, তাকে লোভী বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে — অথচ একই পরিবারের ছেলেটি সম্পত্তিতে তার বাড়তি পাওনাটি ছাড়তে না চাওয়াকে কেউ লোভী বলে আখ্যায়িত করেনি।
এই বৈষম্যের একটি প্রতিক্রিয়ার (অনেকগুলোর মধ্যে একটি) দেখেছি চাকরি জীবনে একটি গবেষণার কাজ করতে গিয়ে। বেশীরভাগ পুরুষই কর্জ (লোন নিয়ে) করে ব্যবসা শুরু করেন। সেই কর্জ অনেক ক্ষেত্রেই পারিবারিক –যেমন বাপের সঞ্চয় থেকে ফেরতযোগ্য ধার–অথবা ব্যাঙ্ক লোনও হয় অনেক সময়। কিন্তু মেয়েরা এই সুবিধা খুবই কম পায়।
ছেলেকে ধার দিতে গিয়ে বাবা চিন্তা করেন, এই সম্পত্তি তো ওরই হবে শেষতক –মেয়েকে কর্জ দিতে গিয়ে চিন্তা করেন, জামাইকে খাইয়ে লাভ কী? ব্যাঙ্ক লোনের ক্ষেত্রেও মেয়েরা পিছিয়ে পড়ে। কারণ collateral দেখাতে হয় –বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য collateral ছিল জমি বা বাড়ি। খুব কম মেয়েরই নিজের মালিকানায় জমি বা বাড়ি ছিল। বাবা-মায়ের সম্পত্তি ছেলেদের ব্যবসার ক্ষেত্রে তারা collateral হিসেবে ব্যবহার করতে রাজি হতেন, কিন্তু মেয়ের ক্ষেত্রে নয় –ওই একই চিন্তা থেকে।
তো বিষয়টি এরকম, মেয়েরা systemic সমস্যার কারণে ব্যবসা জগতে ঠিকমত জায়গা পাচ্ছে না, এবং তারপর মেয়েদের মধ্যে আসলে উদ্যোক্তা মনোবৃত্তিরও (entrepreneurial spirit) ঘাটতি আছে, এটা প্রচলিত ধারণা হয়ে থাকছে।
মেয়েরা সম্পত্তির ভাগ পায় না কেন? সমাজ-মানসে সমস্যা অবশ্যই আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার কিন্তু এই–আইনগতভাবে আমাদের সমান অধিকার নেই। আইনই কিন্তু বৈষম্য নিশ্চিত করছে। এই বৈষম্য কি শুধু সম্পত্তির ক্ষেত্রে?
আমি আইনবিদ নই। নিজের যাপিত জীবন, কর্মজীবনে, নানারকম পড়াশোনার মাধ্যমে কিছু জিনিস জেনেছি।
যেমন বাংলাদেশী মুসলিম সম্প্রদায়ের পারিবারিক আইন অনুযায়ী একজন নারী হিসেবে আমার জন্মগতভাবে তালাকের অধিকার নেই। স্ত্রী হিসেবে আমি তালাকের অধিকার তখনই পাই, যদি বিয়ের কাবিননামায় স্বামী সেই অধিকার আমাকে দান করেন। সেই অধিকারও সীমিত করে দেয়ার ক্ষমতা স্বামীর আছে। কাবিননামার ১৮ নম্বর ঘরে সেই সীমা উল্লেখ করে দেয়ার জন্য জায়গা রাখা আছে। কেন? একটা সম্পর্কের মধ্যে থাকতে চাওয়া বা না চাওয়ার অধিকার যদি জন্মগতভাবে স্বামী পায়, তবে স্ত্রী কেন পাবে না?
স্বামীর তালাকের অধিকার কোনভাবে খর্ব করা হয়েছে কিনা, এ প্রশ্ন কাবিননামায় আছে –কিন্তু তালাকের অধিকার স্বামীর কারো কাছ থেকে পেতে হয় না।
বাংলাদেশের আইন এখনও স্ত্রীর অনিচ্ছায় যৌনসম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণ হিসেবে স্বীকার করে না। অর্থাৎ বিয়ে হওয়া মাত্র নারী নিজের শরীরের ওপর অধিকার হারিয়ে ফেলে। তার যৌন জীবনের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা নির্ভর করবে স্বামীর সদিচ্ছার ওপর।
বাংলাদেশের আইনের অনেক পরিমার্জনা হয়েছে। আইনী জগতে অনেকেই এ নিয়ে কাজ করছেন –সুতরাং ভবিষ্যতে আরো হবে। কিন্তু আজ, যেখানে মেয়েদের বিরুদ্ধে বৈষম্য আইন নিজে বেঁধে দিচ্ছে –সেখানে শতরকম চেষ্টা সত্ত্বেও, গোড়ায়ই আমরা যে মার খেয়ে পড়ছি, তা কিন্তু খুব কঠিন মার।
মেয়েরা কেন জগতে আরো শক্ত হয়ে, আরো দৃপ্ত হয়ে, সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায় না , সেটা বিস্ময়কর নয়। বিস্ময়কর হলো, গোড়াতেই মার খেয়ে থাকা সত্ত্বেও আমার, আপনার, অনেক মেয়েরই উঠে দাঁড়ানোর, ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি।
সব লড়াকুদের জন্য আজকের দিনটি –সব লড়াকুদের জন্য হোক প্রতিটি দিন। শুভ নারী দিবস!