সুমন্দভাষিণী: খবরটি হলো, ঢাকার বনশ্রীতে নিজের দুই সন্তানকে হত্যা করেছে স্বয়ং মা। তিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নিজেই স্বীকার করেছেন একথা। শিশু দুটি হত্যার পর থেকেই বেশ আলোচিত হয়ে উঠে বিষয়টি। আর আজ মা ঘটনাটি স্বীকার করার পর তাতে আরও এক পালক যোগ হয় সমালোচনার-আলোচনার। কেউ কেউ মা জাতিকে কলংকিত বলে বর্ণনা করছে, আবার কেউ বিষয়টির আরও গভীরে যাওয়ার কথাও বলছেন। তাদের মতে, এটা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখা থেকে এক বার্তায় একথা জানানো হয়েছে। ক্ষোভ, পারিবারিক এবং সামাজিক সমস্যা, মানসিক অসুস্থতা, এবং সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের কারণেই মা তার সন্তানদের হত্যা করেছেন। প্রথমে বলেছিলেন, চাইনিজ খাবার খেয়ে তারা মারা গেছে। পরে তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়ায় শেষপর্যন্ত মা স্বীকার করলেন।
টিভি পর্দায় বার বার সেই মাকে দেখানো হচ্ছে। খুব স্বাভাবিক একটি মুখ। অনেকটা পুলিশ মা-বাবাকে হত্যাকারী ঐশীর মতোন। ঐশীকেও খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল এতোবড় ঘটনার পরও। ১৬-১৭ বছর বয়সী কিশোরী ঐশীর ওই ঘটনায় মানসিক কোনো চিকিৎসা হয়নি। এইদেশে এরকম কোনো নিয়ম নেই। মানসিক চিকিৎসা আবার কী? এর প্রয়োজনীয়তাও কেউ উপলব্ধি করে না। অথচ চারপাশে মানসিক অবসাদগ্রস্ত, বিষন্ন হওয়ার কারণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমরা ঐশীর চিকিৎসা না করেই তাকে ফাঁসির আদেশ দিয়ে বসে আছি। কেউ এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করছে না। বয়সটাকেও আমলে নেয়া হয়নি ঐশীর ক্ষেত্রে।
অন্যদিকে বনশ্রীর ঘটনায় আমি মায়ের মুখটা বার বার খেয়াল করছিলাম। ভাবলেশহীন একটা চেহারা। সন্তান হারানোর কোন কষ্ট তার মাঝে নেই। তাহলে কেমন মা তিনি? একবাক্যে মাকে দোষারোপ করা হচ্ছে। বাবা যেহেতু হত্যার কথা স্বীকার করেনি, কাজেই তিনি সন্দেহমুক্ত এখনপর্যন্ত।
আমি ওই মায়ের চেহারার কথা বলছিলাম। মানসিক অবসাদগ্রস্ততা কোন পর্যায়ে পৌঁছালে একজন মা এমন নির্লিপ্তভাবে সন্তান হত্যা করতে পারে? ভেবেছি কেউ? ফেসবুকে সবাই হিসাব মেলাচ্ছেন। কারো হিসাবই মিলছে না। মা কি হত্যাকারি হয়? এই মায়ের মনে কি একবারের জন্যও সন্তানদের মুখ ভেসে উঠছে না? তার কি কান্না পাচ্ছে না? অনুশোচনায় আছড়ে পড়তে ইচ্ছে করছে না? কেউ কি একবারও জিজ্ঞাসা করবে এই মায়ের পিঠে হাত রেখে, মা, কেন তুমি এমন করলে? কোন কষ্টে? কেউ কী বলবে?
ফেসবুকে কাকলী তালুকদার লিখেছেন, “একজন মা তার দুই সন্তানকে নিজ হাতে হত্যা করল!! আমি সত্যিই ঘামছি, বুকের ভিতর ব্যাথা টের পাচ্ছি, বমি আসছে, মাথা ব্যথা করছে!! নিতে পারছি না আর
কিন্তু সেই মা কাঁদছে না!কেউ কি ভেবেছেন কেন? আমার ধারণা যদি সত্য হয়, তবে এই মা কোনোদিন কাঁদবে না আর এই সন্তানের জন্য কারণ তার ভিতরে যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা আমরা বাহির থেকে বুঝতে পারবো না। আমাদের সমাজ দিনের পর দিন কি ভাবে ভারসাম্যহীন জীবন উপহার দিচ্ছে, আগামী দিন গুলোতে আমরা বেশী করে টের পাবো।
মাইক্রোস্কোপ ছাড়া অনেক জীবানু আমরা দেখতে পারি না ঠিক আমাদের দৃষ্টিতে এই মাইক্রোস্কোপ বসানো ছাড়া সমাজের চোরাবালির মতো ভারসাম্যহীনতা দেখা যাবে না। সময় আরও খারাপ কিছু আমাদের উপহার দিবে।”
সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম লিখেছেন, “আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছি না একজন মা তার দুইটি সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে শুধুমাত্র তাঁর ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল বলে..ওই মা ভেবেছিলেন ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে কিছুই করতে পারবে না!!!
যেই মায়ের মেয়েটি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত আর ছেলেটি হলি ক্রিসেন্ট (ইন্টারন্যাশনাল) স্কুল অ্যান্ড কলেজের নার্সারিতে, সেই বাচ্চাদের মা এটা কীভাবে ভাবতে পারে, কীভাবে বাচ্চাদের হত্যা করতে পারে! ! সকাল থেকে যেখানে যাচ্ছি সবাই ই বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করছে! এই ঘটনার গভীরে যাওয়া দরকার। আরও তদন্ত দরকার।”
এদিকে রাশিয়ার এক মা নাকি আল্লাহর নির্দেশে নিজ মেয়েকে গলা কেটে হত্যা করেছে। এর আগে ময়মনসিংহের এক গ্রামে এক বাবা এরকম গায়েবি নির্দেশ পেয়ে নিজ সন্তানকে কোরবানি দিয়েছিলেন। মিরপুরে একজন বাড়িওয়ালীও স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে নির্মাণাধীন বাড়ির জন্য এক শিশুকে হত্যা করেছিলেন। এরকম হাজারটা প্রমাণ মিলবে। গত কয়েকদিনের পত্রিকার খবরে চোখ বুলালেই এরকম শিশু হত্যার অনেক খবর চোখে পড়বে।
উত্তরায় একটা পরিবারটা গ্যাসের আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে গেল, দুই সন্তান ও তাদের বাবা মারা গেল, কোনরকমে বেঁচে আছে সন্তানদের মা ও এক শিশু। সেই মা বলেছেন, আগুন বাসায় ছড়িয়ে পড়ার পর তিনি দৌড়ে সাত তলা থেকে নামার সময় চিৎকার করে সবার সাহায্য চাইছিলেন, পাননি। অনেকেই নাকি দরজা পর্যন্ত খুলেও পরমূহূর্তে তা বন্ধ করে দিয়েছেন, সাহায্য করেননি। মা আক্ষেপ করে বললেন, কেউ যদি কম্বল বা লেপ-তোষক দিয়েও তাদের জড়িয়ে ধরতো, তাহলে বাচ্চারা অন্তত বেঁচে যেতো।
উত্তরার ঘটনা থেকে কী প্রমাণ হয়? আমাদের মানবিক বিপর্যয়, তাই না? মানবিক-মানসিক সব বিপর্যয়ের মুখে পড়েছি আমরা। এ থেকে উত্তরণের উপায় কী? কে উদ্ধার করবে আমাদের? কেন এরকম হলো? আমরা আমাদের আচরণ দিয়েই যে আরেকজনকে বিপর্যস্ত করে তুলছি না, তা ভেবেছি কখনও?
অনেক লেখায় আমি চাইল্ড সাইকোলজি পড়ার অনুরোধ জানাই, আসলে আমাদের পাঠ্যতালিকায় মানবিক মূল্যবোধ, মমত্ববোধ, সহমর্মিতা, মানসিক চিকিৎসার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা এখন ভীষণভাবে জরুরি হয়ে পড়েছে। নইলে আমরা যতো অগ্রগতিই অর্জন করি না কেন, ক্রিকেটে যতো সাফল্যই লাভ করি না কেন, কোনো লাভ হবে না। বিশ্ব এখন এক অস্থির সময় পার করছে, তাই বলে আমরা হাত গুটিয়ে বসে নিজেদের অনিবার্য ধ্বংস দেখতে থাকবো? আমরা অন্তত নিজেদের ঠিক রাখার প্রয়াস চালাতেই পারি। পারি না?
চাইল্ড সাইকোলজি সম্পর্কিত কিছু বইয়ের নাম বললে সুবিধা হয়, বা সাইকোলজি সম্পর্কিত বাংলা বইয়ের নাম