
ফারজানা নীলা: এই বঙ্গদেশে বয়সের ধর্ম লিঙ্গ ভেদে একেক রকম হয়। যে বয়সে একজন ছেলে পারে উত্তাল স্রোতে দৌড়াতে, সেই সময় একজন মেয়েকে বলা হয় “এখন থেকে দৌড়ানো বন্ধ” । যে বয়সে একজন ছেলে পড়ালেখা শেষ করে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজে, সে বয়সে মেয়েদের আমরা বিয়ের জন্য সাজগোজ করাই।
আবার এই বিয়ের বয়স নিয়েও লিঙ্গগত প্রভেদ বিশাল। ২৫ থেকে ৩০ এর দিকে যাওয়া বয়স মেয়েদের জন্য অত্যন্ত নাজুক একটি সময়। এই বয়সে অবশ্যই তাঁর বিয়ে হতে হবে, বাবা-মা -আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী সবার একটাই দাবি “মেয়ের বিয়ে দেওয়া”। তাদের কথার পেছনে অজুহাত আঠার মতো লেগে থাকে, “এই বয়সে বিয়ে না করলে পরে বয়স বেড়ে গেলে পাত্র পাওয়া যাবে না, অথবা দোজবরে বিয়ে দিতে হবে’।
অর্থাৎ এই বয়সে বিয়ে করাই একমাত্র কাজ মেয়েদের জন্য। এবং যেহেতু এই বয়সের উপরে গেলে “পাত্র” পাওয়া যাবে না, সেহেতু এই বয়সে বিয়ে না করলে আজীবন অবিবাহিত থাকার বা ভাল বর না পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বিরাজমান।
সহস্র শতাব্দী ধরে চলে আসা সমাজের এই নিয়মগুলো আমাদের শেখায় যে মেয়েদের জীবনে একমাত্র একটাই লক্ষ্য, ‘বিয়ে করা’। পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করা বা না করা মেয়েদের জীবনে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিয়ে ছাড়া একজন নারীর জীবন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কারণ তাকে নারী হিসেবে পূর্ণতা পেতে হলে মা হতে হবে, আর মা হতে হলে বিয়ে আবশ্যক। বিয়ে ছাড়া মা হওয়া? নাউজুবিল্লাহ।
যদি সময় থাকতে অর্থাৎ ৩০ বা এর আগেই বিয়ে না করা হয় তবে সে তাঁর সৌন্দর্য হারাবে, আর অসুন্দর নারী বা দেখতে একটু বয়স্ক নারীকে কেউ বিয়ে করতে চাইবে না, অর্থাৎ তাঁর জীবন পুরোই ধ্বংস।
কিন্তু সময় পাল্টেছে। এখন অনেক নারীই বিয়েকে জীবনের একমাত্র ব্রত মনে করেন না। তাদের কাছে প্রধান লক্ষ্য জীবনে কিছু অর্জন করা, নিজের যোগ্যতা আর মেধা দিয়ে নিজের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করা। এই পরিচয় তৈরি করতে গিয়ে যদি তাঁকে অধিক সময় ব্যয় করতে হয়, তাতে তার যতো না সমস্যা, আশেপাশে মানুষের গুঞ্জনের অভাব হয় না।
অথচ কেউ তাঁর অর্জনের জন্য তাঁকে বাহবা দিবে না, তাঁর মেধার বিকাশের জন্য প্রশংসা করবে না। সবার চোখে মুখে একটি প্রশ্ন ঘুরঘুর করবে কেন বিয়ে হচ্ছে না? একজন নারী, হোক সে যতোই সফল, তাঁর সকল অর্জন ম্লান হয়ে যায় যদি তাঁর বিয়ে না হয়, বা সে নিজে স্বেচ্ছায় করতে না চায়।
নারীর জীবনে বিয়েকে এতো গুরুত্ব দেওয়া হয় শুধুমাত্র তাঁর নিরাপত্তার অজুহাতে। নারী, সে যতোই সফলতা লাভ করুক না কেন, তাঁর জীবনে যদি কোনো পুরুষ সঙ্গী অর্থাৎ স্বামী না থাকে তবে তাকে উন্মুক্ত বা অনিরাপদ বলা হয়। বেশিরভাগই খারাপ বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়। পারতপক্ষে কেউ বলে না যে মেয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বা জীবনে কিছু হওয়ার জন্য বিয়ে করেনি। আর ইচ্ছে করে বিয়ে করেনি এমন কথা বলার চল বাংলাদেশে এখনও খুবই নগণ্য।
বিয়ে করার বয়স যে নারীদের বেলায় প্রযোজ্য কেবল তাও নয়, পুরুষদের বেলায়ও বয়স অনুযায়ী বিয়ে না করলে অনেক বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়, তবে নারীদের অনুপাতে কম। শুধুমাত্র বিয়ে না করার দায়ে পুরুষের জীবনের সকল অর্জনকে তুচ্ছ করা হয় না। ছেলেদের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় এভাবে যে, আগে জীবনে প্রতিষ্ঠা, তারপর সংসার।
সমাজের এমন বৈষম্যমূলক নিয়মের কারণে মেয়েরাও হার মানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তাদের মগজে বিয়ে, সংসার, সন্তান লালন-পালন জোর করে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, যেখান থেকে বেরুনো কঠিন হয়ে পড়ে মেয়েদের।
অথচ এই নিয়মকেই কেউ তোয়াক্কা না করে যদি কেউ নিজের নিয়মে জীবন যাপন করতে চায় তবে তাঁর জন্য সমাজ যতটা সম্ভব বৈরি পরিবেশ তৈরি করে রাখে। বিয়ে একটি বন্ধন, যেখানে দুজন মানুষ একজন-অপরজনের সাথে স্বেচ্ছায় থাকতে রাজি হয়। বিয়ে হওয়া উচিত ঐচ্ছিক, বাধ্যতামূলক নয়। একজন নারী মানেই পুরুষের মতোই আলাদা সত্ত্বা, তারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী জীবনকে সাজাবে। সেখানে বিয়েটা কেন বাধ্যতামূলক হবে?
সমাজে কতো কতো নজির আছে, মেয়েরা যখন ধাই ধাই করে উপরের দিকে উঠতে থাকে, ক্যারিয়ার গড়তে থাকে, তখন এই বিয়ে নামক প্রথা সবকিছুকে থমকে দেয়। আর সেই বিয়ে যদি মানানসই না হয়, তাহলে উপরে উঠতে থাকা মেয়েটার জীবন স্থবির হয়ে যায় মূহূর্তেই। বেঁচে থেকেও এক দুর্বিষহ নরক যন্ত্রণা তাকে পোহাতে হয়। পুরুষটার ক্ষেত্রেও তাই। কাজেই বিয়ে যেন প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে, সেজন্য একে বাধ্যতামূলক না করে বরং ঐচ্ছিক করা যায়। মন চাইলে করবে, না চাইলে করবে না। দুজন যদি দুজনকে খুব পছন্দই করে, তাদের বনিবনা যদি ঠিক থাকে, একসাথে থাকতেই পারে, যেন কোনো বন্ধন তাদের চলার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। যখন মনে করবে, না এবার সময় হয়েছে, দুজন দুজনকে যথেষ্ট বুঝতে পেরেছি, এবার গাঁটছড়া বাঁধা যাক, তখনই না হয় বিয়ে হবে। এমনকি হতে পারে না?
মেয়েদের বলি, যে নিরাপত্তার ভয়ের জন্য তোমরা বিয়েকেই একমাত্র কাম্য ভাবো সে ভয়টাকে কোনদিন জয় করার চেষ্টা করেছ? একবার চেষ্টা করে দেখাই যাক না, নিজের অর্জিত স্বাধীনতা নাম যশ ক্ষমতার স্বাদ কেমন হয়? ভয়টাকে একটু দূরে রেখে যখন তুমি দেখবে তুমি নিজের যোগ্যতায় নিজের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করতে পেরেছো, যার জন্য সমাজে তোমার একটি আলাদা স্থান তৈরি হয়েছে, যে স্থানের জন্য তোমাকে স্বামীর উপর নির্ভর করতে হয় না তখন তুমি চাইলে কাউকে বিয়ে করলে, না চাইলে করলে না।
জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত একজন সফল মানুষ হওয়া; ভাল বৌ হওয়ার জন্য তোমার জন্ম হয়নি। আর যদি বাধা এসেই যায় তবে তা মোকাবেলার জন্য তৈরি হওয়াও তোমার মেধার মধ্যেই আছে। প্রয়োজন শুধু একটু ঝালিয়ে নেওয়া, আত্মবিশ্বাসী হওয়া আর ভয় নামক শব্দ থেকে দূরে থাকা।