২১ ফেব্রুয়ারি ও আমার ফুল চুরির দিনগুলো

21 2কাকলী তালুকদার: ২১ ফেব্রুয়ারি আসার কয়েকদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যেতো আমাদের সকল প্রস্তুতি। এই দিনটিকে মনে হতো একটা উৎসবের দিন।

তখন আমরা নেত্রকোনা সাতপাই থাকি। আমরা চার ভাই বোন, আশেপাশের আমাদের সমবয়সী যারা ছিল সবাই মিলে শহীদ মিনার বানানোর একটা ধুম শুরু হতো। আমার বড় ভাই সবাইকে দায়িত্ব ভাগ করে দিতো। ফুল চুরি ছিল একটা অনেক বড় দায়িত্ব এবং সেই কাজটার দায়িত্ব পড়তো আমার উপর।

আমার বড় ভাইকে আমি খুব ভয় পেতাম, কিন্তু ওই ২১ ফেব্রুয়ারির কয়েকটা দিন ভয় কাজ করতো না। কারণ ফুল চুরির ব্যাপারে এত দক্ষ চোর আর কোথায় পাবে? সেই মহিমায় ভয় সব নাই হয়ে যেতো। বিভিন্ন রঙের কাগজ কিনে, বাঁশ কেটে চটি বানিয়ে আমরা তৈরি করতাম শহীদ মিনার। ফুল চুরি আর ফুট ফরমাশগুলো আমার দায়িত্বে ছিল।

যাদের বাসায় ফুল গাছ ছিল তারাও কয়েকদিন ধরে পাহারা দেয়া শুরু করতো। সেই পাহারাকে পাহারা দিয়ে ফুল চুরি বিষয়টি খুব একটা সহজ ছিল না। তারপরও আমাদের ফুলের অভাব হয়নি কখনও। তখনও জানি না, একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস, শুধু জানি ওইদিন রফিক, সালাম, জব্বার,বরকত এর মতো অনেকেই মিছিলে গুলি খেয়ে শহীদ হয়েছেন। সেই শহীদদের মনে করতেই ফুল দিতে হয়, আর “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি” এই গানটি গাইতে হয়।

তখন আমি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি। আমার মেঝো বোন চতুর্থ শ্রেণীতে। লেখাপড়ায় সে সবসময়ই ভালো আর আমি ততোটাই ফাঁকিবাজ। সে এক ম্যাডামের কাছে অংক পড়তে যায়, সাথে এক-দুই দিন আমাকে নিয়ে গেছে। আমাকে দেখে তার ম্যাডাম অনেক আদর করলো, বললো কী সুইট তোমার ছোট বোনটা। আর ম্যাডামের সহযোগী মেয়েটিকে বললো আমাকে বিস্কুট দিতে। আমি সেই আদর মাখানো বিস্কুট খেয়ে আসার সময় দেখলাম ফুলের কত বাহার।

মনটা ভরে গেলো, ভাবলাম সামনে একুশে ফেব্রুয়ারি ফুলগুলো খুব কাজে লাগবে, কিন্তু চারদিকে ওয়াল দেখে একটু দুঃশ্চিন্তা কাজ করতে থাকলো। খুশি খালাম্মাদের বাড়ি থেকে কিছু বলে-কয়ে, আর কিছু চুরি করে ফুল নিয়ে আসলাম। আশেপাশের সবার বাসা থেকেই এই ভাবে ফুল সংগ্রহ করেছি। চোখে ভাসছে ম্যাডামের বাসার ফুলগুলো।

মেঝো বোনকে বললাম ম্যাডামের বাসা থেকে ফুল চুরি করতে যাবো, সে বলে না, ম্যাডামের বাসায় চুরি করা ঠিক হবে না। বুঝলাম বোনকে সাথে পাবো না। আমরা যেখানে থাকি, ওখান থেকে ম্যাডামের বাসা অনেকটা দূরে। চোরের তো এত চিন্তা করে লাভ নেই, দায়িত্বে তো অবহেলা করা যাবে না। একাই রওনা হলাম, যেতে যেতে ভাবছি ওয়ালটা ডিঙ্গাবো কেমন করে? ওয়ালের পাশে গিয়ে ঘুরতে লাগলাম আর চিন্তা করতে লাগলাম। অভিজ্ঞতা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সে চুরিরই হউক, ডাকাতিরই হউক।

নারিকেল আর সুপারি গাছ ছাড়া সব গাছেই তো উঠতে পারি। ওয়াল ডিঙিয়ে চলে গেলাম ফুলের কাছে। বুকের ভিতর ধুক ধুক বেড়েই চলছে, এখানে ধরা পড়লে মান-ইজ্জত কিছুই থাকবে না। এত আদর, প্রশংসা সব ধূলিতে গড়াগড়ি খাবে। অনেকগুলো ফুল ছিঁড়ে ফ্রকটা ব্যাগের মতো বানিয়ে ফুলগুলো নিয়ে বের হতে গিয়ে দেখি ম্যাডামের সেই সহযোগী মেয়েটা আমাকে ধরতে আসছে। এবার গেইট খুলে দিলাম দৌড়। সেই মেয়েটিও পিছনে দৌড়াচ্ছে, আমাকে আজ ধরবেই।

kakoliম্যাডামের মুখ, বোনের মুখ, আদর, প্রশংসা সব মনে পড়তে থাকলো আর দৌড়ের গতি বাড়তে থাকলো। মেয়েটি দৌড়তে দৌড়তে আমাকে একবার ধরেই ফেললো, আমি থামি না, মেয়েটি আমাকে ধরে রাখতে পারছে না, ধরলো আমার জামাতে, শব্দ হলো একটা, বুঝলাম আমার জামা ছিঁড়ে গেছে, আমি ততক্ষণে অনেক দূরে চলে আসছি। আমি জামা ধরে আছি ফুলের জন্য। অনেকটা দৌড়ানোর পর পিছনে তাকিয়ে দেখি মেয়েটি আর নেই। এবার থেমে একটু হাঁপিয়ে নিলাম।

আমার প্রিয় হালকা ঘিয়া রঙের জামা পেটের এখানে ছোট্ট টকটকে লাল ফুল বসানো সেই জামা এখনও আমার চোখে লেগে আছে সেই জামাটা ছিঁড়ে গেলো। সেইসাথে কিছু ফুল নিচে পড়ে গেলো। মনটা অনেক খারাপ লাগলো ।কিন্তু যখনই মনে হলে, বিরাট বাঁচা বেঁচে গেলাম এবার অন্তত ম্যাডামের সামনে পড়তে হলো না।21

প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি এলে ফুল চুরি দায়িত্বের সাথেই করেছি, কিন্তু ওই ম্যাডামের বাসার মুখো হইনি আর কোনোদিন। লাল, সবুজ, নীল, গোলাপী অনেক রঙের কাগজ কেটে সেই শহীদ মিনার বানানো হতো। শহীদ মিনারের বুকের জায়গাটা লাল রঙের কাগজে মোড়ানো হতো এটা হচ্ছে শহীদদের বুকের রক্ত।

ফুল দিতে দিতে গান গাইতাম “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি”, পাশে আবার চেয়ে দেখতাম আমার ছোট্ট গলায় গান শুনে কেউ হাসছে কিনা। তখনও জানি না এত সুন্দর গানটির স্রষ্টা, লেখক আবদুল গাফফার চোধুরী। সুরকার আবদুল লতিফ প্রথমে গানটির সুর করলেও আলতাফ মাহমুদের সুরটি পরবর্তীতে জনপ্রিয়তা পায়।

নিজেদের বানানো সেই শহীদ মিনার সারাদিন পাহারা দিতে হতো, নয়তো, অন্যরা এসে এখান থেকেও ফুল চুরি করে নিয়ে যায়। আর দল বেঁধে আমরা দেখতে যেতাম আর কে কে শহীদ মিনার বানিয়েছে, কারটা কত সুন্দর, কার কত ফুল বেশী। উচ্চ বিদ্যালয় পর্যন্ত আমরা প্রতি বছর সেই শহীদ মিনার বানিয়েছি। নেত্রকোনার শহীদ মিনারে আমি তখনও যায়নি।

ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় ময়মনসিংহে মুমিনুন্নিসা কলেজের শহীদ মিনারে আমি প্রথম গিয়েছি। ক্যালগেরিতে অনেক বাঙালী ছিলো, ওখানে একুশে ফেব্রুয়ারির আয়োজন করে বাঙালীরা, এই শহরে আমরা একমাত্র বাঙালী। মেয়েকে আমাদের দিবসগুলোর গল্প বলি, বায়ান্ন, একাত্তরের গল্প বলি। ছোট মানুষ তাই তাদের মতো করেই গল্প গুলো শোনাই। মাথায় যেন বাংলাদেশ নামক দেশটার একটা গল্প থাকে। যেন ভুলে না যায় আমাদের শেকড়টা একটা সবুজ শ্যামল দেশে, যেখানের মানুষগুলো ভালো-মন্দ মিলিয়ে দেশটিকে আঁকড়ে থাকে।

আজ বলছিলাম, তোমার মতো ছোট বেলায় আমরা শহীদ মিনার বানাতাম, মেয়ে উৎসাহী হয়ে বললো মা, আমরাও বানাবো, কী কী লাগবে? আমি বললাম, আমরা কাল চেষ্টা করবো কেমন করে শহীদ মিনার বানানো যায়। মেয়ে প্লাস্টিকের ফুলগুলো দেখিয়ে বললো, কত্তগুলো ফুল আছে আমাদের এইগুলো শহীদ মিনারে দিবো।

আমি বলছি কাল একটা শহীদ মিনার আঁকতেও পারো। আমি চাই মেয়ে একটা ছবি আকুঁক, তার মনে একটা শহীদ মিনারের ছবি গেঁথে থাকুক, যেমন করে আমার ফুল চুরি গেঁথে আছে মনে। কোনোদিন হয়তো নিজেই খুঁজে বের করবে একুশে ফেব্রুয়ারির একটা ইতিহাস, তার শেকড়ের ইতিহাস।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.