আমার লজ্জাবোধ ও ধর্মীয় অনুভূতিগুলো…..

kakoliকাকলী তালুকদার: খুব ছোটবেলায় দেখতাম আমাদের ঘরে যারা কাজ করে তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের ঘরে ঢুকে না। বারান্দায় বসে খায় এবং তারা নিজেদের থালা নিজেরা পরিষ্কার করে। বাকীরা ঘরে বসে খায় এবং তাদের থালা গুলো আমাদের ঘরে যে মহিলা সহযোগী থাকতো সে পরিষ্কার করে।

আমি মাকে জিজ্ঞেস করতাম ওরা বারান্দায় খায় কেন? তাদের থালা তাদেরই পরিষ্কার করতে হয় কেন? মা বলতেন, ওরা জাতে ছোট। আমি বলতাম মাকে, সবাইকে একসাথে খেতে দিতে হবে, সবার থালা যে পরিষ্কার করে তাদেরটাও সেই করবে। মা প্রথম প্রথম হেসে উড়িয়ে দিতো, এই দাবীগুলো সব সময় আমি ও আমার মেঝো বোন যৌথভাবে করতাম।

ওরা যখন বারান্দায় বসতো খেতে, আমি সামনে পড়লে আমার ছোট্ট মনটিতে লজ্জা পেতাম। বারান্দায় বসলে, কাক, মুরগি,বিড়াল, কুকুর খাওয়া দেখলেই বিরক্ত করতে আসতো, তাদের হাতে ছোট একটা লাঠি নিয়ে বসতো। আমি মাঝে মাঝেই সেই লাঠি নিয়ে পাহারা দিতাম তারা যেন নির্বিঘ্নে খেতে পারে, তবে সব সময় থাকতে পারিনি, খেলতে যেতাম বলে।

আমাদের ছোটবেলায় হাতে গোনা যে কয়জন গ্লোকুজ বিস্কুট, লজেন্স, পাইনাপেল বিস্কুটের দাবি পূরণ করতো সেই কৃষ্ণ কাকুও সেই বারান্দায় বসে খাবারের দলে ছিল।

আমরা যখন মামার বাড়ি যেতাম পাঁচ-ছয় জনের বহর নিয়ে, সেখানেও তাদেরকে বারান্দায় খাবার দেয়া হতো। আমি মানতে পারিনি কখনও বিষয়গুলো, নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পেতাম। পরে আমরা এই সকল নিয়ম ভাঙতে পেরেছি। তবে মামার বাড়ির খবর জানি না।

আমি তখন অনার্স পড়ি, একটি বেসরকারী সংস্থায় কাজ করে রোকেয়া আপা, আমাদের গ্রামে তার ফিল্ড ওয়ার্ক থাকতো, আমাদের বাড়িতে গিয়েই থাকতো। গ্রামে এই সকল কর্মীদের থাকার কোন ব্যবস্থা থাকে না। তখন রোজার মাস, রোকেয়া আপা রোজা রাখেন এবং নামাজ পড়েন। আমি মাকে বলে রাখলাম, একটা মুরগি রান্না করে রেখো, ভোরে রোকেয়া আপা সেহরি খেয়ে রোজা রাখবেন।

কিন্ত হঠাৎ মনে হলো অনেক মুসলমান আছেন যারা শুধু মুসলমানদের হাতে জবাই করা মাংস খায়। আমি রোকেয়া আপাকে বললাম, আপা, বলি করা মুরগি খাইতে সমস্যা হলে চলেন আমি আর আপনি মিলে জবাই করি, আর জবাই করার সময় যেহেতু আরেকজন মুসলমান নাই, আমাকে বলে দেন কী কী বলতে হবে, আমি বলবো আপনার সাথে।

আমার এইসব নিয়ে সমস্যা নাই। রোকেয়া আপা আর আমি মিলে বিসমিল্লাহ বলে মুরগি জবাইয়ের কাজটি করলাম, আমার এই সকল আচরণে ঘরের সবাই অভ্যস্ত ছিল।

রাতে রোকেয়া আপা নামাজ পড়বেন, আমার জানা মতে অনেকেই পশ্চিমমুখী হয়ে নামাজের সময় সামনে কোন ছবি রাখেন না। আমি পশ্চিম দিকের কয়েকটি ছবি সরিয়ে দিলাম, আমার কাণ্ড দেখে রোকেয়া আপা হাসছেন। আমি শুধু চেষ্টা করেছি যিনি ধর্মকে সত্যিই ভালোবাসেন উনি যেন সঠিকভাবে সেই কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন আমার উপস্থিতিতে।

220150902152653 (1)আমাদের রান্নাঘরে রোকেয়া আপা ঢুকতে চাইতেন না, আমরা সবাই যখন রান্নাঘরে গল্প করতাম, আপা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন, উনাকে কেউ কোনোদিন না করেননি আমাদের ঘরে, তবে বুঝতে পেরেছি এই সকল পরিস্থিতি উনি ফেইস করেছেন। আমি টেনে উনাকে আমাদের রান্না ঘরে ঢুকিয়েছি।

আমি অস্বস্তি বোধ করতাম, উনার ইতস্তততা দেখে। আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধব আমাদের বাড়িতে যায়, তারাও অনেকেই আমাদের ঘর, মা-বাবাকে, গ্রামকে ভালোবাসে। কেউ কেউ আমাদের ঘরকেও তাদের ঘর মনে করে। আমার ভালো লাগে, তাদের অনুভূতিগুলো।

আমার কিছু স্বজন আছেন যারা পাশের বাড়ির মানুষটি অসুখে মরে যায়, কিন্তু একটিবার গিয়ে জানতে চান না, আমি কি কিছু করতে পারি তোমাদের জন্য। উনারা আবার ভগবানকে নিয়ে মাঝে মাঝেই আসর করেন। না, আমি ওদেরকে কোন সহযোগিতা করার চিন্তাও করি না।

গত বছর যখন দেশে ছিলাম, আমি ঈদ করেছি এক্কেবারে নাইওরী সেজে। দুই বাচ্চাসহ গিয়ে উঠেছি আমার বন্ধু আল্পনার বাসায়। চার-পাঁচ দিন থেকে ঈদ সম্পন্ন করে বাসায় ফিরেছি। খালাম্মা আছেন বাসায়, আমি আম্মা ডাকি, কখনও নাম ধরে ডাকি উনার মায়ের মতো করে। ওই বাসাটা আমার নিজের মনে হয়, আমি নিজেকে ওই বাসার মেয়ে হিসেবে দাবি করি। ভাইজান আর ভাবীকে আমি নিজের ভাই এবং ভাবী মনে করি। ভাবীর কাছে আমার অনেক দাবী, ছোট মাছ রান্না হলেই আমার জন্য আলাদা রেখে দেন, চা আমার খুব প্রিয়, ভাবী সময়ে অসময়ে চা করে দিয়েছেন। ভাবী আমার আর আমার বাচ্চাদের জন্য অনেক করেন। আমার ছেলেটি যখন কোন কারণে কান্না করছিল ভাবী সূরা পরে আমার ছেলের গায়ে ফুঁ দিলেন, আর আমাকে বললেন যে কোন বিপদে এই সূরাটি বলবা, আমি মাথা কাত করে হ্যাঁ বলেছি যদিও, আমার আর মনে নেই এখন।

আমি জানি এইগুলো ভালোবাসা, ভাবী যখন নামাজ পড়েন আমি চেষ্টা করি বাচ্চারা যেন চিৎকার না করে। আমি ঈদে এতো আনন্দ আর কোনোদিন করিনি কখনও। ঈদে আমি আমার পরিবার কাপড় পেয়েছি উপহার, সালামী পেয়েছি, অবশ্যই সালাম করে। আমিও করেছি সেগুলো, সালামিও দিয়েছি। এই গুলো ধর্মীয় অনুভূতি। সমাজের একটা মেল বন্ধন।

আমি সালাম দেয়ার সময় “ আছালামওয়ালাইকুম” বলি কখনো স্লামালিকুম বলি না। আমাকে কেও একজন বলেছিলেন প্রথম তা সঠিক তাই আমি সঠিক উচ্চারণ করার চেষ্টা করি সব সময়। নয়তো অর্থ নাকি পরিবর্তন হয়ে যায়। একজন ছিলেন, আমি ছালাম দিলে উত্তর নিতেন না, পরে জানলাম আমি হিন্দু বইলা উনি উত্তর দেন না, যাহোক পরে উনিও আমার সালাম গ্রহণ করেছেন, আমাকে ঈদে দাওয়াত খাইয়েছেন।

সবগুলোই ধর্মীয় অনুভূতি, এই অনুভূতির মূল্য আমার কাছে অনেক।

আজকাল ধর্মীয় অনুভূতি গুলো কেমন যেন এক রঙের হয়ে যাচ্ছে সাতরং হারিয়ে।মানুষগুলোও কেমন ধার্মিক হয়ে যাচ্ছে, সভ্যতা বক ধার্মিকদের পেটে চলে যাচ্ছে।

হতাশ হতে ভয় পাই, আশা ছাড়া কি মানুষ বাঁচতে পারে? সমাজ ছাড়া কি আমরা বাঁচতে পারবো? আমাদের সম্পর্ক গুলো কি শুধুই ধর্মের? নাকি মানবিকতার? পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের?

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.