আমার বন্ধু বল্লরী

Meye 1ইশরাত জাহান ঊর্মি: বল্লরীর কথা বলতে বলতে সামান্য কাঁদে। আমি ওর হাতে হাত রাখি। কখনও কখনও শান্ত্বনা বাক্যের চেয়েও হাতের মধ্যে হাত রাখাটা অনেক কাজে দেয়। অনেক কথা বলে দেয় নীরব মুখোমুখি বসা।

বল্লরীর কথা আমি আগেও লিখেছিলাম।

আমার বন্ধু। একটা অতি সাধারণ মেয়ে। স্বামী সংসার আর ছোট একটা চাকরী নিয়ে ছোট গৃহকোণে ভীরু দ্বীপ জ্বালা মেয়ে। শ্বশুরবাড়ির মানুষের শঠতার মাঝে টিকোতে না পেরে স্বামীকে নিয়ে আলাদা হয়েছিল সে। তারপর অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা, স্বামী একা ফিরে যায় নিজের পরিবারের কাছে। বল্লরী একা বাড়িতে নিজের সামান্য বেতনের টাকা নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যায়। তারপর একসময় ফিরেও যায় শ্বশুরবাড়ীতে।

ও ওর বরের কথা বলতো, আপা শমিত যদি পুরো খারাপ হতো আমার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হতো, কিন্তু তা তো না, সত্য উত্তম, মিথ্যাও চলতে পারে কিন্তু অর্ধসত্য ভয়ংকর! শমিত অর্ধসত্য, তাই আমি একেবারে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত যেমন নিতে পারি না, তেমন থেকে যাওয়ারও…

যাই হোক, বল্লরীর কিছুদিন একা থাকার কারণেই সম্ভবত ওর সামর্থ্য আর জেদকে কিছুটা সমীহ করে এখন শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। ও তাই ফিরে গেছে।

এবারের ঘটনাটা খালি চোখে খুব সামান্য। কিন্তু দাগগুলো যার পড়ে সে-ই বোঝে কিছু কিছু দাগ বড় দেয়াল তৈরি করে। বল্লরীর ননদের বাচ্চা হয়েছে, অনেকদিন চেষ্টার পর বাচ্চা। বাড়ির সবাই খুব খুশি। বল্লরীও। এটা সেটা রেঁধে ননদের শ্বশুরবাড়ির লোকদের জন্য শুদ্ধ হাসপাতালে খাবার পাঠাচ্ছে, এবেলা ওবেলা অফিসের ফাঁকে হাসপাতালে যাচ্ছে বাচ্চা দেখতে।

এর মধ্যেই একদিন শমিত বলে, নাতাশাকে( বল্লরীর ননদ) আমি কিন্তু বাসায় নিয়ে আসবো, আর এই বেডরুমটা ছেড়ে দিতে হবে। আমি কিন্তু বলে দিয়েছি।

ঠিক বলা নয়, অর্ডার দিয়ে দেওয়া। সিদ্ধান্ত বলে দেয়া।বেডরুমটা বল্লরীর। সেটা ছাড়তে হবে।

বল্লরী বলে, আপা পুরুষরা কেন মেয়েদের সেনসিটিভ জায়গাটা ধরতে পারে না বলতে পারো? একমাত্র বোন, বাবা নেই, ভাই তাকে বাড়ি নিয়ে আসবে, এটা তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য এই যে আমাকে ঘর ছাড়তে হবে এই সিদ্ধান্তটা ও একলা নিল কেন?

ও যদি আমাকে বলতো, বল্লরী, আমি নাতাশাকে আনতে চাই, তুমি ব্যবস্থা করো, তাহলে হয়তো ওকে আমি কিছু করার সুযোগই দিতাম না, নিজেই নাতাশাকে এনে আমার ঘর ছেড়ে দিতাম। সব ব্যবস্থা আমিই করতাম। আমি তো সিদ্ধান্ত নেয়ার এই সম্মানটুকু ডিজার্ভ করি পার্টনারের কাছে, না কি করি না?”

বল্লরী শমিতকে বলছিল, তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছো, তাহলে তো আমার আর কিছু বলার থাকে না। ব্যস এতেই ওর শমিত প্রচণ্ড রেগে গিয়ে ড্রয়িং রুমে সোফায় ঘুমাতে যায়, বল্লরী অনুনয় করতে গেলে বলে, আমার বোনকে আমি আমার বাড়িতে আনবো তোমার পারমিশনের অপেক্ষা করতে হবে আমি তা মনে করি না। তোমার না পোষালে তুমি চলে যেতে পারো।

বল্লরী বলে, আপা,পুরুষ আর নারীর সেনসিটিভিটি কি এতো আলাদা জায়গায়? ওরা কি বোঝে না, প্রপার সম্মানটা দিলে আমরা ফিরিয়ে দিতে পারি একশ ভাগেরও বেশি? মেয়ে মানেই পার্টনারের ক্ষেত্রে ওভার পজিসিভ, ননদ শাশুড়ীকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে, মেয়েরা-এই ধরনের টাইপড ভাবনা থেকে এই এত বছর পরেও পুরুষরা কেন বের হয়ে আসতে পারে না, বলতে পারো?

আমি বলি, বল্লরী, হয়তো আমাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে বোঝানোর ক্ষেত্রে, মেক দেম ফিল যে আমরা তার পরিবারকে নিজের পরিবারই ভাবি, বরং একটু বেশিই ভাবি, তোমরা যদি একটু ছেড়ে দাও, তাহলে দায়িত্বটা পুরোটা আমরা কাঁধে নিতে জানি। আর সেটাই সৌন্দর্য্য, সম্পর্কের সৌন্দর্য্য।

বল্লরী হাসে। বলে : আর কিভাবে ফিল করাবো বলেন? একটা মানুষের পাশে থাকছি, এক বিছানায় ঘুমাচ্ছি, এক থালায় খাচ্ছি, তারপরও যদি না বোঝে!আর এসব হয়তো আপাত: দৃষ্টিতে খুব ছোট বিষয়, কিন্তু এভাবেই একটু একটু করে দেয়াল ওঠে। অনতিক্রম্য দেয়াল।

আমিও হাসি। ওকে বলি না, বল্লরী আসলেই নারী-পুরুষের সেনসিটিভিটির জায়গাগুলো বোধ করি আলাদাই। ওরা মেয়েদের ধরতেই পারে না। খুব মোটাদাগের হয় অধিকাংশ পুরুষ। আর এই যে দেয়ালের কথা বলছো, দেয়ালে তোমার যতটা ক্ষতি হচ্ছে, তোমার পার্টনার কি আর ক্ষতিটাকে সেভাবে দেখছে বলো? এতসব দেয়াল-টেয়াল নিয়ে তাদের ভাবতে বয়েই গেছে।

বল্লরী, তোমার ক্ষতি হলো অনেক, কিন্তু এইসব পুরুষদের জন্য আমার বড্ড করুণা হয়, যারা জানেই না কোথায় তাদের কি ক্ষতি হয়ে যায়! কি সোনার মোহর তারা পেয়েও প্রতিনিয়ত: নিতান্ত মাটির বানিয়ে ফেলে তা!

বল্লরীও চুপচাপ কফি খায় আমার সাথে। কালো কফি। আমরা দুজনেই কালো কফি ভালোবাসি। ও কী ভাবে আমি জানি না, আমরা দুজন বসেই থাকি আর সন্ধ্যা গড়ায়। ছোট ছোট বেদনাগুলি অনিন্দ্যসুন্দর জীবনকে কেবলই পেছনে টেনে ধরে। কেন যে!

 

শেয়ার করুন: