আতিকা রোমা: একদম ছোটবেলায় ভালোবাসার মানে বুঝতাম “রহিম+সকিনা”, ব্যাস এতোটুকুই। যার মানে রহিম নামের ছেলেটি আর সকিনা নামের মেয়েটি খুবই খারাপ এবং যাদেরকে পাড়া-মহল্লার সবাই মোটামুটি বয়কট করেছে এবং যাদের জন্য তাদের পুরো পরিবারের মান-সম্মান ধুলাবালিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর যাদের নিয়ে এতো কিছু, তারা কেমন যেন ভ্যাবলার মতো কিছুই বোঝাবুঝির ধারপাশ দিয়ে না হেটে, মাটির দুই ইঞ্চি ওপর দিয়ে হেটে বেড়াচ্ছে।
এরপর বড় হতে হতে টের পেলাম দুনিয়া জুড়ে রহিম+সকিনার সংখ্যা খুব কম না। বরং চারপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রহিম+সকিনা ও তাদের পরিবার নানান ভাবে গড়াগড়ি এবং মাটির বিভিন্ন স্তরে হাঁটাহাঁটিও করছে। এরপর পরিচয় হতে থাকলো লাইলী-মজনু, শিরি-ফরহাদ, হীর-রঞ্জা, রমিও-জুলিয়েট এদের সাথেও। এরকম কিছু রহিম+সকিনাদের ঘটনার কথা এখন না বললেই নয়, যেগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছি।
আজ থেকে কুড়ি বছর আগেকার, ক্যাসেট প্লেয়ারের জামানায় গানটা ফুল ভলিউমে বাজতো আমাদের সামনের বাড়িতে। গানটি যিনি বাজাতেন, ধরি তার নাম ‘স ভাই’ আর যার উদ্দেশ্যে গানটি বাজানো হতো, তার নাম ‘ম আপা’। ‘স’ ভাই মনে হয় ক্যাসেটের ফিতা ভর্তি করে এই একটি গান যত্ন করে রেকর্ডিং করিয়েছিলেন। তাই অহর্নিশ ও বিরতিহীনভাবে বাজতেই থাকতো মরণযাত্রা।
‘স’ ভাই ব্যাকব্রাশ করা ফিটফাট ছেলে। দেখতে ভাল। প্রথম ধাক্কায় দেখলে মনে হতো মিঠুন চক্রবর্তীর জ্যান্ত আত্মা লোকালয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শোনা যেত, পেটে বিদ্যা আর মাথায় নাকি তার বুদ্ধি নাই।
অন্যদিকে, ‘ম’ আপা যেমন সুন্দরী, তেমনি তুখোড় লেখাপড়ায়। ওনাদের বাড়ীটা ছিল রাস্তার একদম শেষ মাথায়। ‘স’ ভাইয়ের শুভাকাঙ্ক্ষীরা বুদ্ধি দিলেন ক্যাসেট প্লেয়ারের ভলিউমটা আরও একটু বাড়াতে হবে। ‘ম’ আপা নাকি ঠিকঠাক মতো ‘স’ ভাইয়ের ব্যথিত হৃদয়ের হদিস করতে পারছেন না। সাথে সাথেই ‘স’ ভাই বড় বড় আরো দুইটা স্পিকার জুড়ে দিলেন তার ক্যাসেট প্লেয়ারের সাথে।
এরপর শুধু ‘ম’ আপা একা না, ‘ম’ আপার বাড়ীর লোকজন, কাকপক্ষি, মেনিবিড়ালসহ সারা পাড়া-মহল্লার সবার কানেই ‘স’ ভাইয়ের ব্যথিত হৃদয়ের বার্তা পৌঁছে গেল। তবে কারো মধ্যেই ব্যথিত হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না।
অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ‘স’ ভাই বাড়ীর বারান্দায় বসে বসে মুখ ছেয়ে ফেললেন চুল-দাড়ি-গোঁফে। ছোট্ট আমি তখন তীব্র কল্পনা শক্তির বদৌলতে একটি দৃশ্য হরহামেশা দেখতে পেয়ে শিহরিত হোতাম “খাটিয়ায় চড়ে ‘স’ ভাই যাচ্ছেন ‘ম’আপার বাড়ীর সামনে দিয়ে আর ‘ম’ আপা ভাবান্তরহীন ভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুল আচরাচ্ছেন। ‘ম’ আপার বাড়ীর বারান্দার কাছে খাটিয়াটি আসা মাত্রই ‘স’ ভাই ওপরের চাদর সরিয়ে করুণ দৃষ্টিতে ‘ম’ আপার দিকে একবার চাইলেন। কিন্তু কোন ভুরুক্ষেপ না দেখে আবার ঢুকে পরলেন খাটিয়ার ভেতর।” আহা…
মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। এক্ষেত্রেও ঘটনাটা তাই ঘটলো। অল্প কিছুদিন পরে ‘ম’ আপা পড়ালেখা শেষ করে উচ্চশিক্ষিত বর জুটিয়ে বিদেশে রফতানি হয়ে গেলেন। ‘স’ ভাই আরো দুটি স্পিকার লাগালেন ক্যাসেট প্লেয়ারে। হয়তো ভেবেছিলেন প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে “মরণযাত্রা…” ‘ম’ আপা অব্দি পৌঁছাবে।
‘ম’ আপা অব্দি মরণযাত্রার করুণ সুর না পৌঁছালেও, পাশের পাড়ার ‘ল’ আপার কান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছে গেল গানটি। শুরু হলো নতুন প্রেম কাহিনী। এরপর অনেক দিন ‘স’ ভাইয়ের ক্যাসেট প্লেয়ারে শুধু বাজতেই থাকলো “জাস্ট ইস্পিরিট”… উনি বোধ হয় নতুন সম্পর্কে পুরোটা উদ্যম উজার করে দিয়েছিলেন, পুরাতন সব কিছুকে ভুলে।
কিন্তু বিধি বাম। সবাই যখন “জাস্ট ইস্পিরিট”-এ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল ঠিক তার কিছুদিন পরেই সবার অভ্যস্ততায় চিড় ধরে ক্যাসেট প্লেয়ারে আবারো বাজতে শুরু করলো “তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণযাত্রা……”।
ইস্কুলে পড়ার সময় একবার আমার এক সহপাঠী প্রথম পিরিয়ডেই আমার পাশে বসে খুব উশখুশ করছিল আর বার বার তার ব্যাগের দিকে আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিল। যদিও ক্লাস জাতীয় জায়গায় মনোযোগের অবকাশ আমার ছিলনা, তাই তার ব্যাগের দিকেই মনোযোগটা দিতে দেরী করিনি একটুও।
ঘটনা কি?? একটি কাঁটা ভরতি মূমুর্ষ গোলাপ এবং তারচেয়েও বিশ্রী হাতের লেখায় ও বিশ্রী উচ্চারণে ভরা একটি চিঠি। বান্ধবীটি আমার গদগদ। অচিরেই সে সব বিষয়ে লাল কালির দাগ এবং দিন দুনিয়া ভুলে মাটির দুই ইঞ্চি ওপর দিয়ে হাটতে শুরু করলো। আমার মতো এতো বড় শুভাকাঙ্ক্ষীর কথাও তার মনে থাকলো না, কেমন যেন অন্যমনস্ক, জ্বরজ্বারি ভাব।
এরও কিছুদিন পর একদিন প্রথম পিরিয়ডে সে আবার আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলো। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না নতুন করে মনোযোগ আকর্ষণের হেতুটা কি হতে পারে, কারণ ততো দিনে কয়েক দিস্তা কাগজ দুই পক্ষই খরচ করে ফেলেছে। অচিরেই বুঝতে পারলাম, ঘটনা সাংঘাতিক। প্রেমিক ছেলেটি বরাবরের মতোই বিশ্রী হাতের লেখায় এবং একই রকম বিশ্রী রকমের উচ্চারণে একটি চিঠি লিখেছে, তবে কলমের কালি দিয়ে নয়, রক্ত দিয়ে। বান্ধবীটিকে তখন ধরে রাখা দায়। এবার আর সে মাটির ওপর দিয়ে না, সোজা দুটি ডানা লাগিয়ে উড়াল দিয়ে বেড়িয়ে যেতে চাইছে, আর আমি তাকে জোর করে অনতত প্রথম পিরিয়ডে আটকে রাখতে চেষ্টা করছি। এরপর কোন রকমে টেনেটুনে টিফিন পিরিয়ড পর্যন্ত আটকে রাখা গেল। টিফিন পিরিয়ডে বেশ কিছু বিজ্ঞ সহপাঠী জুটে গেল ঘটনার সাথে। কেউ কেউ বললো, “আহারে কি ভালোবাসে তোকে, দেখেছিস হাত কেটে চিঠি লিখে ফেলেছে”, আবার একদল বললো, “কক্ষনোই না, নিশ্চয়ই মুরগির রক্ত দিয়ে লিখেছে”।
এরপর তুমুল তোলপার ও বিশাল দলাদলি। রহস্য রহস্যই থেকে গেল, উদ্ঘাটনের পথ পেল না।
আগে পাড়াপ্রতিবেশীদের মানুষ আত্মীয়র চেয়ে কম কিছু ভাবতো না এবং সুখে দু’খে সবক্ষেত্রেই পাশাপাশি থাকতো। তো একবার প্রচন্ড শীতের মধ্যে বেশ রাতে প্যাঁ পুঁ, প্যাঁ পুঁ করতে করতে এম্বুলেন্স এলো পাড়ায়। সব বাড়ী থেকে লোকজন ঐ শীতের মধ্যেই ছুটে বেড়িয়ে গেল কার বিপদ হয়েছে দেখতে।
দেখা গেল, পাশের বাড়ীর এক ছেলে বিষ খেয়েছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে জানা গেল বিষ খুব বেশী খায়নি এবং খুব ক্ষতিকারক মাত্রার উপাদানও তাতে ছিল না শুধু একটু ছটফটানির মাত্রা ছাড়া। বিষ পানের কারণ অচিরেই উদ্ঘাটিত হলো, সেই চির চেনা রহিম+সকিনা বা মাটির দুই ইঞ্চি ওপর দিয়ে হন্টন। বিষক্রিয়ার কম মাত্রার বিষয়টি এমন ভাবে প্রচার পেয়ে গেল যে, করুণ একটি ঘটনা জনগণকে নির্মল বিনোদন দিতে সক্ষম হলো। কিন্তু প্রায়শই রহিমকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্যাঁ পুঁ, প্যাঁ পুঁ শব্দ তুলে এম্বুলেন্সকে আসতে যেতে দেখা গেল, কখনও বা সকিনার জন্য, কখনও বা জুলেখার জন্য, কখনও বা নাম না জানা সকিনা/জুলেখাদের জন্য।
পরিশেষে, ভালোবাসা দিবস পৃথিবীতে থাকুক বা না থাকুক রহিম+সকিনা পৃথিবীতে থাকবেই, তারা মাটির দুই ইঞ্চি ওপর দিয়েও হাঁটবে এবং বরাবরের মতো তাদের পরিবারগুলোর মানসম্মান ধুলোমাটিতে গড়াগড়িও খাবে, তবে ভালোবাসা কোন দিন শেষ হয়ে যাবে না। জয় ভালোবাসার জয়।