উৎসবে যেন ম্লান না হয় প্রতিবাদের সংস্কৃতিখানি

8 March 3লুতফুননাহার লতা: সবাইকে ভালোবাসা দিবসের, সরস্বতী পূজো আর পয়লা ফাল্গুনের শুভেচ্ছা। ভাবতে ভাল লাগে আমি বাঙালী। আমার আছে অসংখ্য উৎসব, অসংখ্য উদযাপন। ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে নানাজনের নানা মত আছে, তবে আমার কাছে যে কোন দিবসেরই একটি আলাদা ব্যাপার আছে। ভালোবাসার মানুষকে ভালোবাসি একথা বলার জন্যে আলাদা দিন ক্ষণের দরকার হয় না। তবু আলাদা করে একটা দিন উদযাপিত হলে আরো ভাল।

নিউজে পড়লাম এবছর আমেরিকার হাইস্কুল গুলোতে সিনিয়র ক্লাসের ছেলেরা স্কুলের সকল মেয়েদেরকে ফুল দিয়ে উদযাপন করেছে মিড উইন্টার রিসেস এর (স্কুল ২য়বার শীতের বন্ধ) আগের দিনটি। ছুটিতে চলে যাবার আগের দিনটি পালন করেছে ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে।

সারা আমেরিকায় লাখো, কোটি এলিমেন্টারি স্কুল শিশুরা ভ্যাকেশানের আগের দিন স্কুল থেকে বের হয়েছে হাতে একটি রঙিন খামে মোড়ানো ক্লাস প্রজেক্টে বানানো কার্ড নিয়ে। তাতে তারা নিজ হাতে এঁকেছে হ্যাপি ফ্যামিলি, মা, বাবা, দাদা, দাদী, নানা, নানী, খেলার সাথী অথবা যাকেই সে শ্রদ্ধা করে ভালোবাসে তার জন্যে লেখা হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে, আই লাভ ইউ এসব লেখা কার্ড, তাতে আবার কত রকমের কারুকাজ, তীর বেঁধা হার্টের ছবি, সুন্দর করে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। কারো কারো কার্ডে আবার অসংখ্য ভুল বানানে লেখা ভালোবাসার কথা।

এদেশে আসবার পরে প্রথম দু’ এক বছর খুব একটা বুঝতে পারিনি। এ নিয়ে মাথাও ঘামাইনি। কিন্তু ছোট্ট সিদ্ধার্থের কাছ থেকে আঁকাবাঁকা ভুল বানানে লেখা প্রথম ভ্যালেন্টাইনস ডে কার্ড পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছি। তাতে লিখেছে ‘আম্মো আই লাভ ইউ টু ডেথ! হ্যাপী ভ্যালেন্টাইন্স ডে আম্মো। লাভ ইউ!’ চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়েছি এই পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর মায়াভরা মুখখানি। পরে ভ্যালেন্টাইন্স ডের ইতিহাস পড়ে মন খারাপ করেছি।

মনে পড়েছে আমাদের কিশোরী বেলার কথা। ভালোবাসা মহা পাপ। ভালোবেসেছো কী মরেছো। তখন কেবল ভালোবাসা বা প্রেম মানেই হল ছেলের সাথে মেয়ের সম্পর্ক। সমাজের কাছে,পরিবারের কাছে ভয়াবহ অপরাধ! বাবা জানলে খুন। মা জানলে সারাদিন গঞ্জনা। নানী জানলে রাতের বেলা পাশে শুয়ে শুয়ে ইউসুফ- জুলেখার গল্প, আনারকলি সিনেমার গল্প, কেমন করে জীবন্ত আনারকলিকে দেওয়াল তুলে দিয়ে আটকে হত্যা করা হলো ভালোবাসার অপরাধে এবং কোন ছেলেকে ভালোবাসার পরিণাম যে কত ভয়ংকর হতে পারে সে সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা দিয়ে এসব ঝামেলায় না জড়াতে বলা।

স্কুল এবং কলেজ জীবনে যত লাভ স্টোরি পড়েছি তার সবই প্রায় নিদারুণ যন্ত্রণা, অপমান, দুঃখ, কষ্ট, আর না পাওয়া দিয়ে ঘেরা। নজরুলের গানে বিরহ, রবীন্দ্রনাথের গানে বিরহ। আমাদের আকাশ বাতাস ভরা ছিল কেবল বিরহ আর বিরহ। সাথে ছিল সবকিছুতেই বাধা! ‘ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা।’ কিন্তু তাতেই কি আর থেমে থেকেছে কেউ! প্রথম বিপ্লব, প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়েছে প্রেমেরই জন্যে ঘর থেকে।

ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দেবার জন্যে, ভালোবাসার মানুষকে আপন করে পাবার জন্যে একদিন যারা সয়েছেন নির্মম নিষ্ঠুরতা, বলী হয়েছেন অনার কিলিঙের, নানাভাবে মানসিক বা দৈহিক ভাবে হত্যা করা হয়েছে। উপায়ন্তর না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন অগনিত প্রেমিক-প্রেমিকা, আজকের এই দিনটি যদি তাদের প্রতি উৎসর্গিকৃত হয়ে থাকে তবে তার প্রতি আমার শর্তহীন ভালবাসা ও শ্রদ্ধা।

এদিনে ব্রাজিলের অবিবাহিত মেয়েদের একটি বিশেষ রিচুয়ালের কথা পড়ে মনে হলো আমাদের পাক ভারত উপমহাদেশে এই রকম রিচুয়াল রয়েছে আদি থেকেই। শিবের মত স্বামী পাবার জন্যে উপোস থেকে পূজো দেয়া, পয়লা ফাল্গুনে বা সরস্বতী পূজোর দিনে বানীর দেবীকে সাক্ষী রেখে প্রেম নিবেদন, সত্যিই এদিনেই চোখে চোখে কথা বলেছে কত যুগল। কত ছেলে কত মেয়ের প্রেমে পড়েছে তার শেষ নেই, ফলে ভ্যালেন্টাইনস এর ইতিহাস আমাদের দেশে আছে এবং প্রবল ভাবেই আছে ।

যশোরের গদাখালি পাইকারি হাট থেকে একদিনে দুই কোটি টাকার ফুল বিক্রি। কৃষকের মুখে হাসি’ এই সংবাদ আমাকে আনন্দিত করে অগনিত মানুষ ফুল কিনে তার ভালোবাসার মানুষের হাতে তুলে দেবে সেটা আমার চোখে খুশীর অশ্রু আনে।

যদিও জানি এবং বিশ্বাস করি আজ ১৪ ই ফেব্রুয়ারী কলংকিত স্বৈরাচারকে সাথে নিয়ে আমরা স্বৈরাচার বিরোধী দিবসের কথা বলার অধিকার হারিয়েছি। গণতন্ত্রের জন্যে অকাতরে বিলিয়ে দেয়া অগনিত তাজা জীবন আমাদের দুঃস্বপ্নে কেবল বুকের ভেতরেই সমাহিত হয়ে রইল। ক্ষমা করো দীপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, ক্ষমা কোরো ডা. মিলন আর আমার বাড়ীর পাশের তরুণ যুবক মহারাজা! ক্ষমা করো !!

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.