দেশের গণতন্ত্র কি একদলীয় রাজনীতির পথে হাটঁছে?

Three womenহাসিনা আকতার নিগার: এ শীতে উত্তাপবিহীন রাজনীতির মাঠ। গেলো বছর বিএনপি তার নৃশংস রাজনীতির কূটচাল দিয়ে দেশে অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, আর সেই রাজনীতির   বিষাক্ত বিষে তারা নিজেরাই দংশিত হয়ে আজ নির্বাসনে প্রায়। আপাত:দৃষ্টে মনে হয়, সাধারণ মানুষও পরিত্যাগ করেছে তাদের। দাম্ভিকতার রাজনীতিতে অন্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে নিজেদের দোসর করে দীর্ঘ সময় ধরে বিএনপি এ দেশের শাসন ব্যবস্থাতে ছিল। আজ তাদের সেই দিনগুলো বাঙালী জাতির জন্য কলংকিত একটি অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে আওয়ামী সরকার পর পর দুইবার নির্বাচিত হয়ে দেশের মানুষকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নানা প্রতিকূল পরিবেশেও জনগণ সরকারের সাথে সাথে একটি উন্নয়নশীল দেশের স্বপ্ন দেখে বলেই, আজ বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।
সকল পজিটিভ ভাবনাকে সামনে নিয়ে বর্তমান সরকার উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে । কিন্তু বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। সে প্রেক্ষাপটে বর্তমান  সময়ে দেশের সংসদে তেমন কোন অবস্থান নেই বিরোধী দলের। অন্যদিকে রাজনীতির মাঠে নাই কোন শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। তার নানা ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যাও রয়েছে।
বিশেষ করে ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই দেশে একধরনের বিরোধী দলবিহীন সংসদের আভাস দেখা গিয়েছিল। আর সাম্প্রতিককালে তা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।

প্রবাদ আছে, ‘রাজনীতি হলো রাজার চাল।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ধ্যান ধারণা দিয়ে দেশের সামগ্রিক রাজনীতির পট পরিবর্তন করেছেন তার শাসন আমলে।
যার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের বিপক্ষের শক্তিশালী দল বিএনপি একদিকে যেমন জাতীয়ভাবে একঘরে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধকরে এবং জামায়াতের দোসর হয়ে, অন্যদিকে  মামলা সামলাতে গিয়েও তাদের অস্তিত্ব সংকটের মুখে। বলতে গেলে বিএনপি এখন মাঠে-ঘরে  নেতানেত্রী বিহীন একটি দল।

Hasina Nigar
লেখক

বিগত পৌরসভা নির্বাচনে নিজেদের পরাজয়ের পরবর্তী কোন প্রতিক্রিয়া আজ অবধি জোরালো ভাবে দেখা যায়নি। এ অবস্থায় আসন্ন ইউনিয়ন নির্বাচনে তাদের কী ভূমিকা থাকবে তা খুবই অস্পষ্ট। একটি দলের সাংগঠনিক কাঠামো যেখানে নড়বড়ে সেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনার সমালোচনা করার অবস্থান তাদের নেই এটা জনগণের কাছে পরিস্কার ধারণা। তা নাহলে বিএনপি এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে বলতে পারল না তাদের ‘আসল বিএনপি এবং নকল বিএনপি’ – নামক এ নাটকীয় ঘটনা কেন হলো।

অন্যদিকে সরকারে মন্ত্রীত্ব এবং নানা ধরনের পদ-পদবি ধারণ করে নামেমাত্র যে বিরোধী দল সংসদে রয়েছে, সেই জাতীয় পার্টি প্রকৃতপক্ষে জনগণের কাছে কোনো অর্থ বহন করে না। জাতীয় পার্টির কর্ণধার এইচ এম এরশাদ এবং তার স্ত্রী রওশন এরশাদ কখনোই দেশের জনগণের কথা বলেনি কিংবা ভাবেনি। শুধুমাত্র ভোটের রাজনীতির অংক কষতে গিয়ে দেশের দুটি বড় দল তাদের সুবিধামত গ্রহণ এবং বর্জন করেছে। যার ফল স্বরূপ বর্তমান সরকারের আমলেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

Ershad 3গত  ক’দিন ধরে জাতীয় পার্টি নিজেদের দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে যে নাটকের অবতারণা করেছে, তা রাজনীতির শীতল পরিবেশে অনেকটাই হাস্যরসের জোগান দিয়েছে দেশের মানুষকে। যদিও তাদের দল থেকে বলা হচ্ছে, দলের ভাঙ্গাগড়ার এই নাটক দিয়ে তারা বুঝে নিয়েছে এখনও তাদের খবর পত্রিকার পাতাকে চাঙ্গা করে। এটা কোন একটি রাজনৈতিক দলের জন্য যথাযথা যুক্তি নয় যদিও।
বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির পর আলাদা করে আর কোনো দল দেশের রাজনীতিতে নেই বললেই চলে। কারণ সকলেই এ দুটি দলের সহযোগী হিসাবে ১৪ দল এবং ২০ দলের অংশ। এর মাঝে অবশ্য ইসলামি ঐক্যজোটের একাংশ ২০ দল থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনার কোন সুযোগ তেমন থাকছে না।

কিন্তু বিপুলসংখ্যক আসন নিয়ে ক্ষমতাসীন কোন রাজনৈতিক দলের বিপরীতে শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল না থাকাটা গণতন্ত্রকে অনেকাংশেই হুমকির মুখে ফেলে দেয়। জনগণের কাছে জবাবদিহিতার দায়বদ্ধতা গণতান্ত্রিক সরকারের চালিকা শক্তির একটি যন্ত্র। তবে সে জবাবদিহিতাকে সচল রাখতে বিপরীত দিকে শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল থাকা অতীব জরুরী। যা দেশের সরকার ব্যবস্থায় এখন নেই।
সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার সুযোগ তৈরি করতে হলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে মতামত প্রকাশের সে পথ তৈরি করে দিতে হবে সরকারকেই।

বাংলাদেশ একটি গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে নিজেদের গনতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করেছে নানা সময়ে নানাভাবে। সে সংগ্রামের  বিশাল অংশ জুড়ে ছিল আওয়ামী লীগ নিজে। আর সেই আওয়ামী সরকারই যখন রাজনীতির অত্যন্ত সুক্ষ্ম চালে দেশের একটি রাজনৈতিক দল ব্যতীত অন্য দলকে পঙ্গুত্বের দিকে নিয়ে যায়, তখন তা সেই দলটির জন্যও হিতকর নয়।

তাহলে এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, জনগণ কি তবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সরকারি দল ছাড়া অন্যদের প্রতি? এ প্রশ্নের উত্তরটি কোনো দল ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারবে না, যতক্ষণ না দেশের মানুষ ভোটের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশ করতে না পারবে। আওয়ামী সরকারের অধীন স্থানীয় নির্বাচনগুলিকে নানাভাবে পর্যবেক্ষণ করার সাথে সাথে একটি বিষয় উঠে আসে, তাহলো বর্তমান সময়ে স্থানীয় জনগণ ধারণা করে পৌরসভা বা ইউপি সদস্যরা যদি সরকারি দলের না হয় তবে সেক্ষেত্রে এলাকার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। এমন ভাবনা থেকে বর্তমানে স্থানীয় ভোটে অনেক পরিবর্তন দেখা যায়। আর তা দিয়ে সকল রাজনৈতিক দলের অবস্থানকে বিচার করাও সম্ভব নয়।  

দেশের পট পরিবর্তনে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিকে ধারণ এবং লালন করে। আর সে কারণে প্রতিটি দলের অবস্থানকে তারা তাদের নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে বিচার করে। সুতরাং বাংলাদেশ এবং বাঙালী জাতির ইতিহাসকে লুন্ঠিত করার সুযোগ বোধ করি আর নেই। তেমনিভাবে মৌলবাদের নামে ধর্মীয় বিভ্রান্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগও কম।
গণতন্ত্রমনা বাংলাদেশের আর্থ – সামাজিক উন্নয়নের জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন অভ্যন্তরীন সংস্কার দরকার, তেমনিভাবে সরকারকে উন্নয়নের জন্য একদলীয় মনোভাব থেকে সরে আসতে হবে।

যদিও সাদা চোখে মনে হয় বর্তমানে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন দল নেই  – এই বিষয়টি সরকার তার কর্মকাণ্ড দিয়ে যেভাবে প্রকাশ করছে তা জনগণের চিন্তাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে ক্রমশ। তাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র কি একদলীয় রাজনীতির পথে চলবে? এ প্রশ্নটি অংকুরে বিনাশ করার দরকার দেশের এবং জনগণের উন্নয়নের স্বার্থেই।

শেয়ার করুন: