অপ্রিয় আত্মকথন ও পাহাড়ি সত্ত্বা

Sathiমুক্তাশ্রী চাকমা সাথী: অামরা তিন ভাই বোন যেভাবে বড় হয়েছি, তা অার দশটা অাদিবাসী পরিবারের বাচ্চাদের বড় হয়ে ওঠার মতো ছিলো না। অামার মা বাঙ্গালী পরিবারের মেয়ে হওয়ার কারণে,অামাদের প্রায় প্রতিনিয়ত অামাদের কাজ, জীবনাচরণের মাধ্যমে অামরা যে অাদিবাসী/পাহাড়ি সত্ত্বাকে মনে-প্রাণে ভালোবাসি এবং তা ধারণ করতে চাই তা প্রমাণ করতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। হয়তো ভবিষ্যতেও দিতে হবে।

যেহেতু অামার বাবা অাদিবাসী (পড়ুন জংলী, জ্বী হ্যাঁ। এখনো অধিকাংশ বাঙ্গালী এরকমই ধারণা রাখে) সেহেতু অামাদের তিন ভাইবোনকেই বাঙ্গালী অাত্মীয় এবং বাঙ্গালী সমাজের কাছ থেকে ছোটবেলা থেকেই হাসি-তামাশার মুখোশের অাড়ালে অনেক অপমানসূচক কথা শুনতে হয়েছে। “খচ্চর”, “শংকর জাত” এসব উপাধি এখনো অাদিবাসী এবং বাঙ্গালী দুই তরফেরই শত্রু-মিত্র হতে কখনো হাসিচ্ছলে, কখনো অামাদের অপমান করার জন্য দেওয়া হয়।

অামরা তিন ভাইবোনই কোন না কোন কারণে এসব কষ্টকে বুকে নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি, চেষ্টা করছি। অামাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কেন যেন এতো অপমানের পরও অাদিবাসীদের জন্যই বেশী। এর একটা কারণ হতে পারে অামরা খুব কাছ থেকে দেখেছি দুই সমাজেরই জাতীয়তাবাদের নামে উগ্রতা, ভণ্ডামি, অন্য জাতিকে হেয় করার অাপ্রাণ প্রচেষ্টা, যদিও সেখানে মানসিক বিকৃত শান্তি ছাড়া অার কোন লাভ পাওয়ার কোন উপায় ছিলো না।

এবং অামরা বুঝতে পেরেছিলাম অাদিবাসী সমাজটাই সবদিক থেকে লাথ্থি খাচ্ছে। অামার বাবা ৪ মাস ১৯ দিন জেলে ডিটেনশনে ছিলেন, উনার অাদিবাসী অধিকারের জন্য কাজ করার পুরষ্কার ছিলো এই জেল, সরকারের তরফ থেকে। তখন অামার বাঙ্গালী মা’ই প্রথম মামলা লড়বেন বলে ঠিক করলেন।

অামরা প্রথমদিকে তখন খুব কম অাদিবাসীদের অামাদের সাথে পেয়েছি। তার যথেষ্ট কারণও ছিলো। তখন যাকে ইচ্ছে তাকে গুম করে ফেলা যেতো, সংবাদপত্রে কোন খবরই অাসতো না, সেই সময় সরকারের বিরুদ্ধে মামলা যে করা যায় , তা ভাবার মতো সাহস অাদিবাসীদের না থাকাটাই স্বাভাবিক ছিলো।

hill 2অামার বাঙ্গালী মা গুটি গুটি ছেলেমেয়ে (অামার বয়স তখন ১২, ভাইয়ের ১১) ফেলে সেই সাহসের কাজ করে ফেললেন। বাঙ্গালী- পাহাড়ী, জাতীয়-অান্তর্জাতিক অনেকেই অামাদের সাথে ছিলেন। অামরা মা যখন মামলা শেষ করে বাড়ি ফিরলেন, মাকে চিনতে পারছিলাম না। অনেকদিন মাকে দেখিনি তাই, মায়ের চেহারা ভেঙ্গে গিয়েছিলো।

যতটুকু জানি, এটাই ছিল পাহাড়ীদের অন্যায়ভাবে কারাগারে অাটকে রাখার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা। ব্যারিস্টার অামিরুল ইসলাম অামাদের মামলা লড়লেন, অামরা জিতলাম অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এই মামলার সূত্র ধরে বাবাসহ অারো অনেকে মুক্তি পেলেন। অাদিবাসী গায়ক কালায়ন চাকমা, বর্তমান প্রথম অালোর ফটো সাংবাদিক সুপ্রিয় চাকমাসহ অারো অনেকে।

কিন্তু অামরা এরপর ভীষণ অর্থ কষ্টে পড়ে গেলাম। অামার বাবার কখনো নিয়মিত অায় ছিলো না। হাতির দাঁতের শিল্পী হিসেবে কখনো তিন মাসে একবার অায় হতো, কখনো না। তারও বড় একটা অংশ চলে যেতো সমাজের কাজে, অধিকারের কাজে। মামলা লড়েও অামাদের যা সঞ্চয় ছিলো, তা শেষ হয়ে গেলো। অামাদের বাসায় পেপার বন্ধ করে দেওয়া হলো, অামরা হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম, যাওয়ার পথে বাসে করে যাওয়া বন্ধুদের টা টা দিতাম। কোন বিজুতে অামরা নতুন জামা পাইনি, যেদিন বাসায় মাংস অাসতো, অামি অার কালো (অামার ছোট ভাই) অাগে-ভাগে স্নান করে টেবিলে বসে যেতাম।

অামরা নিজেদের সব কাজ নিজেরাই করতাম। ঘর মোছা হতে বাজার করা। খেলতে গেলে বন্ধুদের বাবা মায়েরা বলাবলি করতো, অামার মা বাঙ্গালী, বাবা চাকমা। অামরা ছোট ছোট ভাইবোন বাসায় এসে গলাগলি করে একজন অারেকজনের ভিতর অাশ্রয় খুঁজতাম।

hillঅামার দিদি তখন ভারতে। ওকেও কল্পনা চাকমার মতো অপহরণ করা হতে পারে এই ভয়ে অার ভালো লেখাপড়া করার অাশায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এখন যখন অামি অাদিবাসী- বাঙ্গালী ছেলেমেয়েদের দেখি তারা অামাদের জীবন ফুলে ভরা ছিলো ভাবছে, তখন অামার শুধু এটাই বলতে ইচ্ছে করে, ” না গো। সোনা ময়না পাখি। অামরা অামাদের মতো করে লড়েছি। অাদিবাসী বাঙ্গালী দুই পক্ষেরই উগ্র মানুষের সাথে। অামরা জীবন দিয়েই জানি, কোন মানুষের সংগ্রামের সাথে অার একজনের সংগ্রামের তুলনা করাটা বোকামি এবং কষ্টদায়ক। অাসো অামরা মাথা খাটাই। যার যার যতোটুকু মানুষ হিসেবে সম্মান এবং অধিকার প্রাপ্য তার জন্য জীবন বাজি রাখি। অাসো নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি বন্ধ করি।”

শেয়ার করুন: