উইমেন চ্যাপ্টার: আজ ২৬ জুন। ১৯৯৮ সালের এই দিনেই শহীদ জননী জাহানারা ইমাম আমাদের উপর রাজ্যের দায়িত্ব অর্পণ করে বিদায় নেন। একাত্তরের শহীদ, নির্ভীক গেরিলা শহীদ রুমির মা। এ প্রজন্মের সকলেই তাঁকে ‘আম্মা’ বলেই ডাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করে তাঁর বুকের মানিক রুমিকে। সন্তান হারানোর পর তিনি শোক পেয়েছেন ঠিকই। কিন্তু ভেঙ্গে পড়েননি কখনো। একাত্তরের প্রতিটা মুহুর্তকে তিনি খোদাই করে রেখেছিলেন তাঁর পাথর কঠিন চিত্তে। সেই স্মৃতিই তিনি ঢেলে দিয়েছিলেন তাঁর কালজয়ী বই ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে। সন্তান শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েননি। একজন রুমি নয়, প্রতিটি গেরিলাই যেন ছিলেন তাঁর সন্তান। একে একে অনেক সন্তানকেই হারিয়েছেন আর একটু একটু করে কঠিন পাথর হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চুড়ান্ত বিজয়ের তিনদিন আগে হারিয়েছিলেন তার জীবন সঙ্গী শরীফ ইমামকেও।
সন্তান ও স্বামী শোকে পাথর জাহানারা ইমামকে মুক্তিযুদ্ধের পরে রুমীর বন্ধুরা মুক্তিযুদ্ধের সকল ‘শহীদের জননী’ আখ্যা দেন। সেই থেকে তিনি ‘শহীদ জননী’। এতদিন শুধু সন্তান আর স্বামী হারানোর বেদনা ছিলো; কিন্তু হঠাৎ করেই ৩০ লাখ শহীদের জননী হয়ে তিনি সন্তানদের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার পণ করেন। সামরিক শাসনের অবসান ঘটলে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারী ১০১ সদস্যবিশিষ্ট ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি’ গড়ে তোলেন। এই কমিটি ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ১০টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারক সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। সমবেত লক্ষ লক্ষ মানুষের পক্ষ থেকে জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
এই গণআদালতের সদস্য ছিলেন : সর্বজনাব অ্যাডভোকেট গাজিউল হক, ড. আহমদ শরীফ, স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, বেগম সুফিয়া কামাল, কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, শওকত ওসমান, লে’ কর্নেল (অব.) কাজী নূরুউজ্জামান, লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী এবং ব্যারিষ্টার শওকত আলী খান। সেদিন পুলিশ ও বিডিআরের কঠিন ব্যারিকেড ভেঙ্গে বিশাল জনস্রোত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে পড়েছিলো। সেই বিশৃঙ্খল পরিবেশে বর্ষীয়ান কবি বেগম সুফিয়া কামাল ও কথাশিল্পী শওকত ওসমানকে গণআদালত মঞ্চে (ট্রাকে) উপস্থিত করা সম্ভব হয়নি বলে মাওলানা আবদুল আউয়ালকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে গণআদালত সদস্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
সেসময় ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার গণআদালতের ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়। যদিও পরে জামিন দিতে বাধ্য হয়। বিরোধী সরকার তখন বাধ্য হয় ৪ দফা চুক্তি করতে। যদিও সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। এদিকে গণরায় কার্যকর করার জন্য তাঁর সংগ্রাম চলতে থাকে। ২৬ মার্চ ১৯৯৩ স্বাধীনতা দিসবে গণআদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরো ৮ জন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর ২৬ মার্চ ১৯৯৪ স্বাধীনতা দিবসে গণআদালতের ২য় বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান কবি বেগম সুফিয়া কামাল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে রাজপথের বিশাল জনসমাবেশে জাহানারা ইমামের হাতে জাতীয় গণতদন্ত কমিশিনের রিপোর্ট হস্তান্তর করেন।
আন্দোলনের ব্যস্ততার কারণে তিনি ভুলেই যান তাঁর ক্যান্সারের কথা। ডুবে গিয়ে ছিলেন সন্তানদের হত্যার প্রতিশোধের নেশায়। হঠাৎ শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। ২ এপ্রিল ১৯৯৪ চিকিৎসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ডেট্রয়েট হাসপাতালে নিয়ে গেলে ২২ এপ্রিল ওখানকার চিকিৎসকরা জানান, চিকিৎসার আওতার সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেছেন তিনি। অবশেষে দেশবাসীকে অশ্রুসাগরে ভাসিয়ে ২৬ জুন ১৯৯৪ বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় মিশিগানের ডেট্রয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
তাঁর সংগ্রাম প্রতিটি প্রজন্মকে শিক্ষা দেয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে। তিনি শিখিয়েছেন কিভাবে সংগ্রাম করে বাঁচতে হয়। কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য নিজের প্রাণকে উৎসর্গ করতে হয়। তিনিই শিখিয়ে গেছেন দালালের সাথে কোন সমযোতা করা বাঙ্গালির ধর্ম নয়।
আজ তাঁর লাখ লাখ সন্তান তাঁকেই স্মরণ করেই রজাকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। রাজাকার বিরোধী যেকোন আন্দোলন যেন তাঁর উপস্থিতি ছাড়া একেবারেই অসম্পূর্ণ। তাইতো শাহাবাগের আন্দোলনের জাহানারা ইমামের ছবিটি দেখে মনে হচ্ছিলো আম্মা গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে লাখো সন্তানকে আগলে রাজাকার ঘাতক দালালদের হুঁশিয়ারি বার্তা দিচ্ছেন।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের উপস্থিতি এখন হয়তো আর প্রকাশ্যে নেই। কিন্তু এ প্রজন্মের আম্মা বেঁচে আছে প্রতিটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীর হৃদয়ে। মা এর মতোন তিনি আজো পথ দেখান প্রতিটি আন্দোলনের। এ প্রজন্মের প্রতিটি লড়াকুর পথ প্রদর্শক হয়ে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন তিনি। তাঁর মৃত্যু নেই।
এই দিনে দেহত্যাগী শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে সশ্রদ্ধ সালাম। আপনি বেঁচে থাকবেন প্রতিটি লড়াকুর প্রাণে প্রেরণা হয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীর কাছে আম্মা হয়ে। আর প্রতিটি ঘাতকের প্রাণে প্রলয়ংকারী সাইক্লোন হয়ে। প্রজন্ম আজ সপথ করুক শহীদ জননীর সংগ্রামের বিজয় না ছিনিয়ে আনা পর্যন্ত ক্ষান্ত দিবে না, ক্লান্ত হবে না। প্রজন্ম আজ পণ করুক, জয় না আনা পর্যন্ত রাজপথ ছাড়বে না। প্রজন্ম আজ সমস্বরে বলে উঠুক, ‘আমাদের জয় হবেই।’ বিশ্বাস রেখো প্রজন্ম, শহীদ জননীর আশির্বাদ তোমাদের সাথেই আছে।
জীবদ্দশায় তিনি একাত্তরের দিনগুলি ছাড়াও লিখেছেন অনেক বই, শিশু সাহিত্য, কিশোর গল্প, অনুবাদ সর্বক্ষত্রেই তাঁর বিচরণ ছিলো। নিম্নে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া হলো: ১। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের ‘লিটল হাউস অন দ্য প্রেইরীর’ সিরিজের অনুবাদ ‘তেপান্তরের ছোট্ট শহর’।
২। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় একই সিরিজের ‘অন দ্য ব্যাঙ্ক অব প্লাম ক্রীক’ এর অনুবাদ ‘নদীর তীরে ফুলের মেলা’।
৩। ১৯৬৭ সালে সাতটি কিশোর গল্পের সংকলন ‘সাতটি তারার ঝিকিমিকি’ প্রকাশিত হয়।
৪। ১৯৬৮ সালে কনরাড রিক্টার-এর ‘দ্য টাউন’-এর অনুবাদ ‘নগরী’ প্রকাশিত হয়।
৫। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় কিশোর উপন্যাস ‘গজকচ্ছপ’।
৬। ১৯৮৩ সালে বিদেশীদের বাংলা শেখার বই ‘এ্যান ইনট্রোডাকশন টু বেঙ্গলী ল্যাংগুয়েজ এ্যান্ড লিটারেচার’ (পার্ট ওয়ান) প্রকাশিত হয়।
৭। ১৯৮৩ সালে ‘ডালাস’ অনুবাদ করেন।
৮। ১৯৮৫ সালে শৈশব এবং যৌবনের স্মৃতিকথা ‘অন্য জীবন’ প্রকাশিত হয়।
৯। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় ৭জন বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে জীবনী গ্রন্থ ‘বীরশ্রষ্ঠ’।
১০। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘বুকের ভেতর আগুন’।
১১। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় ডায়েরি আকারে লেখা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় স্মৃতিকথা ‘একাত্তরের দিনগুলি’। এই গ্রন্থটির কারণে জাহানারা ইমাম দেশে-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেন ।
১২। ১৯৮৮ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্পের বই ‘জীবন মৃত্যু’ প্রকাশিত হয় ।
১৩। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘একাত্তরের দিনগুলি’-র কিশোর সংস্করণ ‘বিদায় দে মা ঘুরে আসি’।
১৪। ১৯৮৯ সালে শেক্সপিয়ারের ‘ট্রাজেডি’-র কিশোর সংস্করণ ‘চিরায়ত সাহিত্য’ প্রকাশিত হয়।
১৫। ১৯৯০ সালে ‘নাটকের অবসানে’ প্রকাশিত হয়।
১৬। ১৯৯০ সালে ‘দুই মেরু’ প্রকাশিত হয়।
১৭। ১৯৯০ সালে ‘নিঃসঙ্গ পাইন’ প্রকাশিত হয়।
১৮। ১৯৯০ সালে ‘নয় এ মধুর খেলা’ প্রকাশিত হয়।
১৯। ১৯৯০ সালে একাত্তরের দিনগুলির ইংরেজি অনুবাদ ‘অব ব্লাড এন্ড ফায়ার’ প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেন প্রয়াত পররাষ্ট্র সচিব মুস্তাফিজুর রহমান।
২০। ‘মূল ধারায় চলেছি’ ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয়।
২১। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ক্যান্সারের সাথে বসবাস’।
২২। ১৯৯২ সালে ডায়েরি আকারে লেখা স্মৃতিকথা ‘প্রবাসের দিনলিপি’ প্রকাশিত হয়।
তথ্যসূত্র: গুণীজন