শারমিন শামস্: আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করছি বইমেলার জন্য। লেখক ও ব্লগার ড. অভিজিৎ রায়ের রক্তের দাগ তো তেমনি আছে। বন্যার ক্ষত তেমনি দগদগে। আমাদের ভিতরের হাহাকার আর শূন্যতা, ক্ষোভ আর ক্রোধ, আতঙ্ক আর বিভীষিকার আশংকা- একটুও হালকা হয়নি কিছু। মনের অবচেতনে কি আরো কোন হত্যা দেখার অপেক্ষা করছি আমরা?
ফেব্রুয়ারি বরাবরই ছিল প্রিয় মাস। ২৬ তারিখ ছিল প্রিয় দিন, আমার জন্মদিন। আজ ফেব্রুয়ারি আসছে আতঙ্ক নিয়ে। ২৬ একটি বিষাদমাখা সংখ্যা। বছরের পর বছর পার হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতির ধারা বয়ে। আশ্চর্য নির্বিকার চারপাশ! জানি না কোথায় চলেছি আমরা! জানি না কোথায় চলেছে স্বদেশ!
বইমেলায় ঢুকবো আতঙ্ক বুকে চেপে। চারপাশে যাকেই দেখব, মনে হবে, ঐ চলেছে খুনি, হাতের ঝোলায় তার বই নয়, আছে চাপাতি। শেষমেষ বই কিনে ফিরে আসি যদি, সৃষ্টিকর্তাকে বারবার ধন্যবাদ জানাবো।
মেলার চারপাশের উৎসব, গান, কবিতা আর আলোকোজ্জ্বল ঝলমলে আয়োজন বড় বেকুব আর বিবর্ণ মনে হবে, আমি জানি। তবু এই বিবর্ণতার ভিতরেই মেলা মাঠে হাজার হাজার স্টলের মাথা উঁচু করে জেগে ওঠা, এটাই তো আমাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। মেলা বসবে, প্রাণের মেলা, বইমেলা কখনো বন্ধ হবে না। বাঙালি তার শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে একুশের বইমেলার আয়োজন করবে, এই বিশ্বাস বুকের ভিতরে এখনো ধিকিধিকি আগুনের মত জ্বলছে।
ফয়সাল আরেফিন দীপনের জাগৃতির স্টলে যাবো। বই কিনবো। আহমেদ রশীদ টুটুলের শুদ্ধস্বর এ যাবো। বই কিনবো। বই পড়ার চেয়ে সুন্দর কোন ঘটনা আমার জীবনে নাই। বই আমাকে, আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। শত প্রতিকূলতা আর আতঙ্ক মাথায় নিয়েও আমরা বইমেলায় যাবো, ঘাতকের বিরুদ্ধে এটাই আমাদের লড়াই।
কিন্তু যদি ঝরে যায় আর কোনো অভিজিৎ, আর কোনো দীপন, সেই আঘাত আসার জন্য নির্বিকার অপেক্ষায়ও কি থাকতে হবে প্রতি মুহূর্তে? লাখ লাখ দর্শণার্থীর ভিড়ের ভিতরে কি মিশে থাকবে রক্তলোভী শয়তান, যারা আমাদের জাতিসত্ত্বার মূলে আঘাত করতে উদ্যত নখ নিয়ে ছুটে আসছে বারবার?
এই বইমেলায় অভিজিৎ বা অনন্ত বিজয়ের নতুন কোন বই আসবে না। যতোদূর জানি, জাগৃতি থাকছে দীপনের স্ত্রীর হাত ধরে, কিন্তু আহত টুটুলের শুদ্ধস্বর নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে। আসছে বছর কি নতুন প্রকাশনা সংস্থা যোগ হবে? নাকি ঝরে যাবে আরো অনেক কয়টি তালিকা থেকে?
আমাদের কি অধিকার আছে জানার, ঠিক কতটা নিরাপদ হবে এবারের বইমেলা? বিচারের জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমাদের শক্ত কঠিন চামড়ায় কলঙ্কের যে ক্লেদ জমে গেছে, অনুভূতিহীনতার যে খোলশে আটকে গেছি আজ, আমাদের কি জানার অধিকার আছে- সেই ক্লেদ সেই খোলস ছেড়ে হাজার বছরের বাংলার ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে নির্বিঘ্নে উদযাপনের দিন, কোনদিন কি ফিরে আসবে আবার?