‘বেলাশেষে’ এবং সম্পর্ক: একটি পর্যালোচনা

Belasheshe 2ফারহানা হাফিজ: বেশ কদিন ধরে অনেকেই ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া কলকাতার সিনেমা “বেলাশেষে” নিয়ে তাদের মতামত দিচ্ছেন। সিনেমার বিষয়বস্তুটাই এমন যা মানুষকে ভাবতে বা ভাবতে বাধ্য করবে।

কী সেই ভাবনা?

সংক্ষেপে যদি বলি, কলকাতায় বসবাসকারী বিশ্বনাথ ও আরতীর ৪৯ বছরের সংসার জীবন তিন মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে। দশমী উপলক্ষ্যে এই দম্পতি সব ছেলেমেয়ে ও তাদের সন্তানদের ডাকে বিশ্বনাথ কিছু বলবে বলে। পূজা শেষে ঘরোয়া বৈঠকে বিশ্বনাথ জানান, তিনি আরতীকে ডিভোর্স করতে চান, কারণ তাঁর মনে হয়েছে, ৪৯ বছরের সংসার জীবনে তিনি আরতীর কাছ থেকে কিছু পাননি, যেভাবে তিনি চেয়েছেন। সবকিছুই একটি নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

বিশ্বনাথের ভাষায়, আরতীর জীবন অনেক বেশী সংসারের তেল, নুন, চিনির মধ্যে সীমাবদ্ধ, যেখানে বিশ্বনাথের মনোজগত কলকাতার প্রকাশনা থেকে শুরু করে সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের আনাগোনায় উদ্দীপ্ত। কাহিনী এগিয়ে যেতে থাকলে আমরা এও জানতে পারি, ৪৯ বছরে বিশ্বনাথ ও আরতীর জানা হয়নি একে অপরের ভালো লাগা, স্বপ্নের কথা।

মোদ্দা কথায় মানসিক বা শারীরিক কোন দিক থেকেই বিশ্বনাথ ও আরতীর ভালোবাসার বন্ধনটি মজবুত নয়, যদিও এগুলো শোনা গেছে বিশ্বনাথের কথায়। আরতীর ভাবনাটি সিনেমাতে পরে আসে, এবং সেখানেই দর্শক হিসেবে, নারী হিসেবে আমার আপত্তি আছে। সে কথায় পরে আসছি।

“বেলাশেষে” সিনেমাটি বিষয় নির্বাচনের দিক থেকে অত্যন্ত সময়োপযোগী। দর্শকের মনের কোনে, সমাজের বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে সনাতন ধারণার বুকে আঘাত দিয়ে সিনেমাটির কাহিনী শুরু হয়। কিন্তু কাহিনী যতো এগোতে থাকে, আমরা দেখতে পাই কিভাবে আধুনিক হতে গিয়েও সিনেমাটি দাম্পত্য জীবনের চিরন্তন যে ধারণা তার চোরাগলির মধ্যেই হারিয়ে যায়।

Belashesheকিছুটা আলোর দ্বীপশিখা হয়ে উঠছিলো যখন আরতীর কন্ঠে শুনতে পাই সংগীতের রাগ-রাগীনির সুর। কিন্তু পরক্ষণেই তা উবে যায় আরতীর নাতনীকে তেল মাখানোর স্বপ্ন প্রকাশের মধ্যে। কিংবা আশার আলো হয়ে উঠছিলো যখন আরতী বলেন, বিশ্বনাথ তাঁর জন্মদিন মনে রাখতে পারেনি। কিন্তু তা জ্বলে উঠার আগেই নিভে যায় যখন আরতী বলেন, বিশ্বনাথকে আর তাঁর পরিবারের সবাইকে সেবার মধ্যেই তিনি প্রেম খুঁজে পান। তীব্র একটা আওয়াজ ছিলো আরতীর বিশ্বনাথের প্রতি “যাওয়ার সময় তো বলে যাওনি, এখন ফেরার সময় কেন?” কিন্তু সেই আওয়াজ মিইয়ে যায় আরতীরই কথায়, “ভেতরটা আমি আর বাহিরটা তুমি সামলাবে, এমনটাই তো কথা ছিলো”।

শুরুতে যে বলেছিলাম, বিষয় নির্বাচনটা ঠিক ছিল, কিন্তু কাহিনীর আবর্তে দেখতে পেলাম পুরোটাই বিশ্বনাথের চোখে, তার মেধা ও মননের চাহিদার মাপকাঠিতে। এখানে আরতীর ভাবনার প্রতিফলন আবারও সেই সংসারের ঘেরাটোপের মধ্যে। যদিও শেষবেলায় আরতীকে কিছুটা স্বাবলম্বি করে দেখানোর একটা প্রয়াস ছিলো, কিন্তু তাও তো বিশ্বনাথের পছন্দে বা তার চাপিয়ে দেয়া বৃত্তের মধ্যে।

ব্যক্তি হিসেবে সব সময় বিশ্বাস করি, বৈবাহিক সম্পর্কের সুরটা কখনও দায়িত্ববোধের উপর ভিত্তি করে বাজতে পারেনা, এটা বাজতে হবে পারস্পরিক অনুধাবন, পারস্পরিক উপভোগ ও পারস্পরিক উদযাপনের ঢঙে, সেটা মানসিক তো বটেই, শারীরিক দিক থেকেও। দায়িত্ব সেখানে একটি অনুষঙ্গ মাত্র। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতিতে অনুষঙ্গটাই মূল হয়ে যায়, আর প্রতিদিন বিশ্বনাথ ও আরতীর মতো ৪৯ কেন, ৬০ বছরেও একে অপরকে জানার, ভালোবাসার দরকার হয় না।

সিনেমা সবসময় সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার, আর ‘বেলাশেষে’ একটি হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারতো আরতীর চরিত্রটিকে ভিন্নভাবে দেখানো হলে। বা বিশ্বনাথ ও আরতীর সন্তানরা যদি বাবা-মার বেডরুমে ভিডিও ক্যামেরার মাধ্যমে কথোপকথনটা না শুনে মুখোমুখি হতেন।

লেখাটা শেষ করছি আর ভাবছি আমার প্রিয় পরিচালক প্রয়াত ঋতুপর্ণের কথা। যদি ঋতুপর্ণ এ্রই ছবিটির পরিচালক হতেন, তাহলে কী অসামান্যই না একটি সিনেমা হতো! যেমনটি পেয়েছি Memories in March কে।

তারপরও সবশেষে বলবো, বিষয়বস্তু, নির্মাণশৈলী ও অভিনয় গুনে ” বেলাশেষে” একটি ভালো সিনেমা যা সবার দেখা উচিত এবং অনুধাবন করা উচিত সম্পর্ক প্রতিদিনের পরিচর্যার বিষয়, হোক তা মানসিক বা শারীরিক।

শেয়ার করুন:

প্রথমত যেটি দিয়ে শুরু করতে চাই আপনার লেখাটি আমার পছন্দ হয়েছে। আপনার ভাবনাগুলো নারীকে একজন মানুষ হিসেবে দেখার জায়গাটি থেকে মুলত এসেছে। কিন্তু ঐ যে ভালোবাসা’ এই শব্দটির সাথে আপনার সাথে আমার মতের কিছুটা পার্থক্যর গন্ধ পাচ্ছি। আমি বেলাশেষে সিনেমাটি দেখেছি। আমাদের সামাজিক অবস্থানকে তুলে ধরা হয়েছে সিনেমাটিতে। ৪৯ বছরের সাংসারিক জীবনের একজন নারীর ভাালোবাসার বহি:প্রকাশগুলো আমাকে কিন্তু টেনেছে। এই যেমন ভেজা তোয়ালা দিয়ে গা মোছা’’ হাতে ছোয়া মাছটি খেয়ে ফেলা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার কোথাও মনে হয়নি এখানে নারীকে তথাকথিত চিত্রে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এটি একেক জনের ভালোবাসার বহি:প্রকাশ। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি নারী-পুরুষের সামাজিক পরিচয়ের দিকটি বিবেচনা করে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিটিকে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় সব কিছুতেই যদি আমরা জেন্ডার বিশ্লেষণ নিয়ে আসি তবে আমাদের পিছিয়ে পড়তে হবে অনেকখানি, সমাজের ভেতরে বহুদিনের ভালোবাসার চর্চাগুলোকে সম্মান না করে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো অনেকখানি। আমার বাবাকে দেখেছি আমার মায়ের ভেজা গামছা দিয়ে গা মুছতে, ফেলে রাখা গ্লাসের পানিটি খেয়ে ফেলতে। জানতেও চেয়েছি উত্তর দিয়েছে, তোর মাকে ভালোবাসি। ভেজা গামছায় তোর মায়ের গন্ধ পাই। এটাও একই রকম ভালোবাসা। যদিও সিনেমাটিতে এই উল্টো চিত্রটিই দেখানো যেতো কিন্তু সেটা না দেখিয়ে খুব বেশি অসংবেদনশীল হয়ে যায়নি বিষয়টি। আমরা নারী অধিকারের কথা বলবো তবে ভালোবাসার বহি:প্রকাশের ব্যাখাতেও নারী অধিকারকে সংযুক্ত করে নয়। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ লেখাটি তুলে ধরবার জন্যে।