ড. সীনা আক্তার: কিছুদিন থেকে ‘হ্যাপি ব্লিডিং’ নামে একটা প্রচারকার্য দেখছি। বিষয়টা মেয়েদের রজঃস্রাব বা মাসিক (Menstruation)নিয়ে। মাসিক একটা সাধারণ শারীরিক প্রক্রিয়া যা বয়ো:সন্ধিতে শুরু হয়, সাধারণত মেয়েদের ৮-১২ বছরের মধ্যে মাসিক শুরু হয় এবং এটা বন্ধ হয় আগে পিছে ৫০ বছর বয়সে।
আমাদের সমাজে মাসিক নিয়ে সচেতনতার অভাব আছে, ফলে নানা রকম ফিসফাস আছে, ট্যাবু আছে। আমাদের স্কুল শিক্ষায় বয়ো:সন্ধিতে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে পড়ানো হয় না। মেয়েদের মাসিক নিয়ে যতটুকু পড়ানো হয় তা ‘স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া’ হিসাবে না দেখে বরং ‘মেয়েদের বিশেষ বিষয়’ হিসাবে পড়ানো হয়। এতে করে কিশোরদের মধ্যে অনাকাংখিত কৌতুহল তৈরি হয়।
অনেক কম বয়সী ছেলেরা কখনো কখনো এটা নিয়ে হাসাহাসি করে, জোক করে বা নোংড়া কটুক্তি করে। মাসিক নিয়ে অজ্ঞতা ও ট্যাবু দূর হওয়া দরকার। কিন্তু ‘হ্যাপি ব্লিডিং’ শ্লোগানটাই আমার কাছে বিভ্রান্তিকর মনে হয়।
মাসিকের সময়টা সামলানো কি হ্যাপি বা সুখি হবার মতো কোন বিষয়! আমার কাছে অন্তত তা মনে হয় না। মাসিকের দিনগুলো অনেকের জন্য যন্ত্রণাদায়ক, প্রায় সবার জন্যই অসস্তিকর, এবং অজ্ঞতা বা অসাবধানতায় কখনো কখনো বিব্রতকরও। কেউ বিতর্ক করতে পারেন যে মাসিক একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তাই এটা নিয়ে বিব্রত হবার কিছু নেই।
এক্ষেত্রে আমার দ্বিমত আছে। সুস্থ কেউ প্রাকৃতিক চাপ সামলাতে না পেরে মল/মূত্রে কাপড় নষ্ট করলে সেটা যেমন বিব্রতকর, ঠিক তেমনি মাসিক চলাকালীন পরিধানের কাপড় নষ্ট হলে বিশেষ করে জনসমক্ষে তা বিব্রতকর। যথেষ্ট সচেতনতা এবং ব্যবস্থা থাকার পরও অনেক মেয়ে বিশেষ করে কিশোরীরা মাসিক সামলাতে সমস্যায় পড়েন।
সেক্স, মল-মূত্র ত্যাগ যেমন স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া, তেমনি নির্দিষ্ট বয়সে মেয়েদের মাসিক এবং ছেলেদের স্বপ্নদোষ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এগুলো মানুষের একান্ত বিষয়, তাই এসব নিয়ে আলোচনা ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে ঘটে। যেমন, নিরাপদ সেক্স এর জন্য কনডম ব্যবহারের কথা বলা হয় প্রকাশ্যে, কিন্তু কনডম কখন, কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তা ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে আলোচনা করা হয়।
আমাদের সমাজ সংস্কৃতিতে এটাই শোভন। কিন্তু এই মাসিক বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ট্যাবু ভাঙ্গার প্রচার পদ্ধতিতে সামাজিক নৈতিক সীমা লঙ্ঘন হচ্ছে মনে হয়। যেমন এক মেয়ের লেখায় দেখলাম মাসিক সামলানোর জন্য টেমপন (Tampon)কিভাবে ব্যবহার করতে হয় তার বিস্তারিত বর্ণনা! আরেকজনের লেখায় জানলাম, একজন রক্তমাখা প্যাড দিয়ে প্রোফাইল করেছে! এতে মনে হয় কখন, কোথায় সীমা টানতে হয় সে বিষয়ে অনেকের ধারণা নেই।
মাসিক কী, কেন, কখন হয় এবং এ সময়ের জরুরি পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সকলেরই সচেতনতা দরকার, কিন্তু মাসিক কীভাবে সামলাতে হয় তা নির্দিষ্ট কিশোরী-নারীর সাথে ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে আলোচনা করাটাই শোভন। প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য এই আলোচনা হতে পারে আস্থাভাজন বন্ধু, আত্মীয় বা সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীর সাথে।
মাসিক সামলাতে নারীরা কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন, যাদের সাধ্য আছে তারা প্যাড (Sanitary pads) বা টেমপন ব্যবহার করেন। সম্প্রতি হ্যাপি ব্লিডিং (!) প্রচারের সাথে যুক্ত হয়েছে প্যাড সংগ্রহ বা প্যাড ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান। এর উদ্দেশ্য রীতিমতো গোলমেলে মনে হচ্ছে। কারণ এই প্যাড প্রচারে বলা হচ্ছে, এটা নিরাপদ এবং কাপড় ব্যবহার অস্বাস্থ্যকর বা রোগ হতে পারে।
আসলেই কি তাই! যাই ব্যবহার করা হোক, মূল বিষয়টা হচ্ছে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যকরভাবে মাসিক সামলানো। আমাদের দেশে অধিকাংশ নারী মাসিক সামলাতে পুরোনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন, প্যাড ব্যবহার করেন না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে অনেক নারী প্যাডের কথা জানেনই না। প্যাড ব্যবহার অবশ্যই সুবিধাজনক, কিন্তু কাপড় ব্যবহার অসুবিধাজনক না, অনিরাপদও না। পুরোনো সুতি শাড়ি বা কাপড় যা ব্যবহারে নরম হয়ে যায়, তা যথাযথভাবে পরিস্কার করে মাসিকের সময় ব্যবহার করলে কোন সমস্যা নেই।
এতে সুবিধা হচ্ছে সহজলভ্যতা, কোন অর্থ খরচ হয় না, চাইলে সঠিকভাবে পরিস্কার করে একাধিকবার ব্যবহার করা যায়। পুরো বিষয়টিতে একজন নারীর নিয়ন্ত্রণ থাকে। অন্যদিকে, প্যাডে যেমন সুবিধা আছে, তেমন সমস্যাও আছে। প্যাড মানেই স্বাস্থ্যকর এই ধারণা সবসময় ঠিক না। প্যাডে স্বাস্থ্যসম্মত উপাদান এবং তৈরি প্রক্রিয়ায় মান নিয়ন্ত্রণ সঠিকভাবে না হলে সেই প্যাড ব্যবহার বিপদজনক এবং রোগের কারণ হতে পারে।
আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী অর্থনৈতিকভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল ফলে প্যাডের খরচ তাদের জন্য বাড়তি একটা চাপ, এমনকি প্যাডের দাম ১ টাকা হলেও। এছাড়া, প্যাড একাধিকবার ব্যবহার করা যায় না, পরিত্যক্ত প্যাড পুনর্ব্যবহারযোগ্য (Recycling) করার কোনো ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই। ফলে এই পরিত্যক্ত প্যাড পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে, যেমনটা হয়েছে পলিথিন ব্যাগের ক্ষেত্রে।
মেয়েদের মাসিক নিয়ে নারী-পুরুষ সকলেরই প্রাথমিক সচেতনতা দরকার। মাসিক চলাকালীন শারীরিক অসুবিধা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মাসিক সামলানোর পদ্ধতি সম্পর্কে সকল মেয়ে বা নারীর সঠিক জ্ঞান থাকা দরকার। বয়ো:সন্ধির আগেই মেয়েদের এ বিষয়ে সচেতন করা জরুরি, কারণ এর জন্য মানসিক প্রস্তুতি থাকলে মাসিক মোকাবেলা করা সহজতর হয়।
আমাদের নিজস্ব, প্রচলিত উপকরণ দিয়েই স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মাসিক সামলানো যায় এবং এর জন্য সঠিক পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে জ্ঞান থাকাই যথেষ্ট। পরিশেষে, মেয়েদের মাসিক নিয়ে ফিসফিস করার কিছু নেই, আবার ঢোল পিটানোরও কোন দরকার নেই।
লেখক: সমাজবিদ।