শিরিন বানু মিতিল একজন মুক্তিযোদ্ধা। জন্ম ১৯৫০ সালের ২ সেপ্টেম্বর। মুক্তিযুদ্ধের সময় বন্দুক হাতে যুদ্ধ করে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। গল্পোচ্ছলে তিনি বলছিলেন, বাংলাদেশের জন্মকথা। তাঁর সেই বীরত্বের গল্প তিনি করেছেন একটি অনলাইন পত্রিকার সাথে। সেখান থেকেই লেখাটি উইমেন চ্যাপ্টারের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো:
যুদ্ধের সময়কার গল্প বলুন, কীভাবে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিলেন?
শিরিন বানু মিতিল: গ্রামের মানুষ মিলিটারিদের প্রথমে ঘিরে ফেলে। এদের হাতে তেমন অস্ত্রশস্ত্র নেই, বঁটি, দা, মাছধরা কোঁচ, শাবল, হেঁসে, বল্লম, যে যা পেয়েছে নিয়ে এসেছে। বাকিদের হাতে যে অস্ত্র আছে মিলিটারিদের তুলনায় তা একেবারেই নিতান্ত। সুতরাং কৌশলের আশ্রয় নিতেই হবে। মিলিটারিরা গুলি করা শুরু করল, ঘিরে ধরা মানুষ কেউ বাধা দিল না। তারা জানে মিলিটারিদের গুলি এক সময় ফুরাবেই। সুতরাং ফুরাল। তারপর ঘিরে ধরা লোকজন ওদের মেরে ফেলল। এসব যখন আমি শুনতাম, তখন আমার খুব মন খারাপ হতো। রাস্তা-ঘাটে জনগণ ব্যারিকেড দিচ্ছে, মিলিটারিদের মেরে ফেলছে, আমার ভাইয়েরা সেখানে যাচ্ছে, অথচ আমি যেতে পারছি না; কারণ আমি মেয়ে। তখন আমার ভাই জিঞ্জির (জাহিদ হাসান) একদিন আমাকে এসে বলল, প্রীতিলতা তো প্যান্ট-শার্ট পরত তুইও তো পরতে পারিস। তখন আমি আমার ভাইদের প্যান্ট-শার্ট-জুতা নিলাম আলনা থেকে, আমার চুলও ছিল ছেলেদের মতো করে ছাঁটা, সুতরাং আমি পুরোপুরি ছেলে হয়ে গেলাম। বন্ধুক হাতে চলে গেলাম ছেলেদের দলে।
আপনি তো পারিবারিক সূত্রেই রাজনৈতিক জীবনযাপন এবং রাজনীতির সুক্ষ্ম চিন্তা খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। সে প্রসঙ্গে যদি কিছু বলতেন।
শিরিন বানু মিতিল: আমার নানা খান বাহাদুর ওয়াছের আলীর রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য অমাকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি জমিদারদের বিরুদ্ধে সাধারণ প্রজার হয়ে কথা বলতেন। সেজন্য জমিদাররা তার মাথার মূল্য ধরেছিল দশ হাজার টাকা। আমার মামারা গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমার মা সেলিনা বানুও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির স্টাডি সার্কেল ও মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ছাত্র ফেডারেশনের পাবনা জেলার ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট থেকে বৃহত্তর রাজশাহী জেলার এমপি নির্বাচিত হন। মার রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন আমিও। মা যখন রাজনৈতিক কারণে জেলে তখন আমার বয়স ৫ বছর পেরোয়নি। সুতরাং মার সঙ্গে আমাকেও জেলেই থাকতে হলো। এসবই মার কাছ থেকে জানা।
রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা কীভাবে?
শিরিন বানু মিতিল: আমার ছোটবেলায় মা আমাকে নীহার রঞ্জনের ‘ছোটদের রাজনীতি’, ‘ছোটদের অর্থনীতি’, বই দুটি পড়তে দিয়েছিলেন। যদিও তখন ওই বইপড়া ছিল নিষিদ্ধ। আমি মোটামুটি ছোটবেলা থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়লাম। ১৯৬৯ সালে আমি গণআন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। পাবনা এবং কুমিল্লায় দু’জায়গাতেই আমি কাজ করতাম। মূলত পারিবারিক কারণেই আমাকে নিয়মিত এ দুই জায়গাতে যাতায়াত করতে হতো। ১৯৭০ সালে কুমিল্লা থেকে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজে বদলি হয়ে চলে এলাম, তারপর ছাত্র ইউনিয়নের রাশিয়ান গ্রুপ, অর্থাৎ মতিয়া চৌধুরীর গ্রুপে যোগ দিলাম। ’৭০-এর মধ্যে নির্বাচনের ফল ঘোষণা হলো। জুলফিকার আলী ভুট্টো মেনে নিলেন না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিলেন। আমরা তখন ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পাবনার আঠারটা থানায় গিয়ে গিয়ে কর্মীদের বোঝাতে শুরু করলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কীভাবে আপনারা মানুষকে উজ্জীবিত করতেন?
শিরিন বানু মিতিল: আমরা তাদের বোঝাতাম, দরকার হলে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে, হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হবে। পাকসেনার ২৪০ জনের মতো একটা গ্রুপ ২৪ তারিখ রাতেই পাবনা চলে এলো। পাবনার ডিসি নুরুল কাদের খানের নেতৃত্বে পাবনা পুলিশ লাইন থেকে অস্ত্র নিয়ে তুলে দেয়া হলো সাধারণ মানুষের হাতে এবং ২৪০ জনের পাক সেনার দলটি পাবনার জনগণের হাতে মৃত্যুবরণ করল।
ছেলেদের পোশাক পড়ে কোন রকম সমস্যা হয়নি?
শিরিন বানু মিতিল: ঠিক সমস্যা নয়, আমাকে নিয়ে আমার সহযোদ্ধারা অনেক মজা করত। তো একবার হয়েছে কি, ভারত থেকে সাংবাদিক এলো আমাকে নিয়ে ফিচার লিখবে। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলছি। বগা কাকা (আবদুর রব) কাকে যেন বলছেন কিরে, এই ছোট ছেলের সঙ্গে ইন্ডিয়ার সাংবাদিক কি কথা বলে? তারপর আমাকে দেখে বগা কাকা বলে, আরে মিতিল তুই? আমি বলি, আরে ধুর! বোনের মেয়েকে চেন না?
কখন কীভাবে ইন্ডিয়া গেলেন? তখনকার সময়ের ঘটনা যদি বলেন?
শিরিন বানু মিতিল: আমি ইন্ডিয়ায় চলে গেলাম এপ্রিলে। গোবরা ক্যাম্পে। তখন ওই ক্যাম্পে ছিলেন বিভা সরকার, কৃষ্ণদাস, যূথিকা চক্রবর্তী। এই সময়েই আমাকে ছেলেদের গ্রুপ থেকে আলাদা করে দেয়া হয়। যাই হোক আমি তখন পরিচিত মিতিল খন্দকার নামে। সবাই আমাকে ছেলে বলেই জানে। ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ থেকে আমাদের খাওয়ার জন্য ২-৩ রুপি দিলো। তখন ওই ক্যাম্পে অনেকেই সাহায্যের জন্য টাকা জমা দিত। আমরা খেয়ে-দেয়ে গোল হয়ে বসে আছি। তখন আমাকে দেখে একজন চিনে ফেলল, বলল. ‘আরে আরে এটা শিরিন বানু না?’ তখন বিষয়টি জেনে গেল সবাই। ছেলেদের ক্যাম্পে আমাকে আর না পাঠিয়ে ইলা মিত্রের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সেখানে কিছুদিন থাকার পর আমাকে পাঠানো হয় মেয়েদের ক্যাম্পে। আমার প্রচ- ইচ্ছা যুদ্ধ করার, কিন্তু তখন একটা অস্ত্র পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার ছিল। একজন মারা গেলে তারপর অস্ত্র ফাঁকা হবে। আর সেটা পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের না দিয়ে কোন নারী মুক্তিযোদ্ধাকে দেবে তা ভাবাই যেত না। আমি নার্সিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিলাম। তখন মেয়েদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল, কারণ তারা যেন ফ্রন্টে গিয়ে সেবাদান সঙ্গে সঙ্গে প্র্রয়োজনে যুদ্ধও করতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের জন্য আপনার কি বলার আছে?
শিরিন বানু মিতিল: বর্তমান প্রজন্ম যেন সঠিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে। তারা যেন শেকড়কে ভুলে না যায়।
বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে কিছু বলুন?
শিরিন বানু মিতিল: যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ দান করেছেন এবং অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন, তাদের যেমন আমি মুক্তিযোদ্ধা বলি তেমনি এই নারীদের আমি বীরাঙ্গনা না বলে মুক্তিযোদ্ধা বলতে চাই।
Such an encouraging, brave lady. Proud of having a cousin like her.