‘পিরিয়ড’ নিয়ে লজ্জার শেষ কোথায়?

Napkin 2সেবিকা দেবনাথ: আমার মনে হয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি লজ্জা বাংলাদেশের মেয়েদের। কত কিছুতেই যে লজ্জা আমাদের। যেকথা সবাই জানে, সেই বিষয়েও আমাদের লজ্জার অন্ত নাই। শুধু কি তা-ই ওসব কথা শুনলেও যেন লজ্জায় কান দিয়ে ধোঁয়া বের হয় আমাদের।

অথচ বিষয়টা কিছুই না। পিরিয়ড, মাসিক, ঋতুস্রাব, মিন্সটেশন এ শব্দগুলো কি ছেলে-মেয়ে কারও অজানা? তবুও এটা নিয়ে কত সংকোচ। এসব শব্দ উচ্চারণ না করে অনেকে একে আদর করে বলে ‘শরীর খারাপ’। ওটা ‘শরীর খারাপ’ হতে যাবে কেন? প্রকৃতির নিয়মে নির্দিষ্ট সময়ে শরীরের স্বাভাবিক একটা ঘটনাকে ‘শরীর খারাপ’ আখ্যা দিয়ে দেই। অনেককে তো ‘মাসিক’ শব্দটা শুনলেও মুখ টিপে হাসতে দেখি আমি।

যেমন মাসিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন এসব নিয়েও যখন কথা হয়, তখনও কিছু মজা লুটেরা মুখ টিপে হাসে এবং ইঙ্গিতপূর্ণভাবে দ্বিতীয়বার শব্দটা উচ্চারণ করেন। এখন আসি কেন এসব অশ্লীল বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলে ‘নির্লজ্জ’ তকমা গায়ে লাগাচ্ছি। (অশ্লীল, নির্লজ্জ বললাম এ জন্য যে এই লেখা পড়ে অনেকেই বিরক্ত হবেন। এবং বলবেন এসব নিয়ে আবার কথা বলার কি আছে?)।

গতকাল সকালে রিপোর্টের প্রয়োজনে গিয়েছিলাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। অফিসে ফেরার পথে ফার্মগেট থেকে উঠলাম বিআরটিসি দোতলা গাড়িতে। আমার সাথে সাথে হলিক্রস কলেজের দুজন ছাত্রীও উঠলো বাসে। আমি চালকের পেছনে রাখা চার সিটের একটি ফাঁকা পেয়ে বসে পড়লাম। দরজার পাশে মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত (টু সিটে) বসলো ওরা দু’জন। বাসটা তখন পল্টনের কাছাকাছি।

বাসের হেল্পার গলা ফাটিয়ে ডাকছে, ‘এই পল্টন নামেন, পল্টন নামেন’। মেয়ে দুটো উঠে দরজার কাছে এলো। ওরা উঠে যাবার পর দেখলাম একটা মেয়ের জামার পেছনে একটু অংশ লাল হয়ে আছে। আমার মনে হলো বাস-শুদ্ধ লোক মেয়েটার সাদা জামার ওই লাল অংশের দিকে ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে। যাত্রী মেয়েগুলো যেন লজ্জায় মুখ লুকাতে পারলে বাঁচে। সহপাঠী মেয়েটিরও লজ্জার অন্ত নেই। সহপাঠী বিষয়টি ওই মেয়েটিকে জানাতে মেয়েটাও যেন লজ্জায় মরে যাচ্ছিল। গায়ের নেভি ব্লু রঙের সোয়েটারটা খুলে মেয়েটি কোমরে বেঁধে নিয়ে ‘মরমে মরে’ যাচ্ছে এমন মুখ নিয়ে বাস থেকে নামলো।

আমি দেখলাম মেয়েটি যে সিটে বসে ছিল সেখানে পড়ে আছে দুটা আনারের বিচি! আমরা পল্টন নামলাম। ওদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছিল ‘ভাগ্যিস মেয়েটার গায়ে সোয়েটারটা ছিল’।

আরেকটি ঘটনা বলি। ঘটনাটা যদিও বেশ কয়েক বছর আগে। তখন আমি আজিমপুর কলোনিতে সাবলেট থাকি। বিকেলে সময় পেলে প্রায়ই হাঁটতে বের হতাম। একদিন দেখলাম, একটা মেয়ে (অনার্স পড়ুয়া হবে) অনেকক্ষণ একটা ফার্মেসিতে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানটায় ভিড় অনেক। (সেখানে ফোনে টাকা রিচার্জ হতো, বাসা ভাড়া কোথায় পাওয়া যায় সেই খবরও থাকতো)। আমি কলোনিতে বেশ খানিকটা হেঁটে আসার পরও দেখলাম মেয়েটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের দোকানে মুদি সদাই করতে গিয়ে দেখলাম, মেয়েটা দোকানদারকে মুখে কিছু না বলে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে দিলো সে প্যাড কিনতে চায়।

আমি জানি এই ঘটনা এখনও ঘটে। ফার্মেসি থেকে স্যানিটারি প্যাড কিনতে এখনও অনেকে (শুধু কিশোরী বা তরুণী নন, মধ্য বয়স্ক নারীরাও) সংকোচ বোধ করেন। কোন ফার্মেসিতে চেংরা বয়সী ছেলে থাকলে তখন অনেক মেয়েই প্যাড কিনতে যান না। প্যাড কেনার সময় খোঁজ করেন কোন ফার্মেসিতে বয়স্ক বিক্রেতা এবং ভিড় কম।

কথায় কথায় এত লজ্জা আমাদের আসে কোথা থেকে কে জানে, কথায় আছে ‘লজ্জা নারীর ভূষণ’ তাই বলে সব বিষয়ে এতো লজ্জা? এতো লজ্জা কতটা যৌক্তিক? ভাবি ভাবি আর ভাবতেই থাকি আমি।

লেখক: সাংবাদিক

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.