মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে দেখেছি আমি

71 war 1তানিয়া মোর্শেদ: প্রায় সারাদিন ফেইসবুকে বিভিন্ন জনের পোস্ট পড়ছি, নিজে লিখছি। ভাবলাম এখন একটু বিরতি নেই। এক বড় ভায়ের থেকে শেয়ার করা পোস্ট তা হতে দিলো না। চোখ বন্ধ করতেই আবার জল পড়া শুরু হলো। তিনি একজনের গান শেয়ার করেছেন। গায়ক যিনি তাঁর শিশু কন্যার জন্য গান লিখেন, লিখেছেন ১৯৭১-এর শরণার্থী শিবিরে আট লক্ষ শিশুর অনাহার, অপুষ্টি, কলেরায় মৃত্যু নিয়ে। যুদ্ধ নিয়ে গান। ছবিগুলো যে কোনো মানুষকে কাঁদাবে। আর সেখানে আমার মত মানুষ তো কথাই নেই।

যুদ্ধের কথা সেভাবে মনে থাকবার কথা নয় আমার। তবুও মনে আছে। প্রচণ্ড নাড়া দেওয়া বিষয় মনে হয় অনেক অল্প বয়সে ঘটলেও মনে থাকে। আগে লিখেছি কিছু। সেগুলো আর পুনরাবৃত্তি করি না।

গ্রামে এক মাস থাকবার পর বাধ্য হয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। আমরা যখন ঢুকছিলাম তখন আমাদের স্কুলের মাঠের ঘাস বড় হয়েছে। তার মধ্যে পাকিস্তানি আর্মি ছিল। টমটমে করে ঢুকলাম ক্যাম্পাসে। ঢুকলাম যেন এক ক্যান্টনমেন্টে!

আমাদের ফ্ল্যাট ছিল তিনতলায়। একতলায় ছিল এক রাজাকার শিক্ষক। বাবার সাথে তার মত পার্থক্যের কারণে সম্পর্ক ভালো না আগে থেকেই। প্রতি সন্ধ্যায় তার কিশোর ছেলে নিচে থেকে হুঙ্কার দিতো আমাদের ফ্ল্যাট লক্ষ করে। মাঝে মাঝে তার সংগী হতো আমার এক বন্ধুর ভাই। তারা অন্য বাড়িতে থাকতো।

তার বাবা আরো নামকরা রাজাকার। মায়ের এক কাজিনের মেয়ে, দূর সম্পর্কের আরেক কাজিনের মেয়েকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। একজনের বাবাকে আর্মি ধরেছিল আমরা সেই গ্রাম ছাড়বার পরদিন। দু’জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। একজনের বাড়ি গ্রামে। তাঁর চাচার বাড়িতে আমরা এক মাস ছিলাম। গ্রামের অবস্থা এতোই খারাপ যে তিনি আমাদের বাসায় এলেন! কী বুদ্ধি সবার!

প্রতিদিন ভাবতাম এই বুঝি বাবা-মাকে আর্মি ধরে নিয়ে যাবে! পেছনের বিল্ডিং-এ একদিন অবাংগালী রাজাকার শিক্ষকের সহায়তায় আর্মিরা লুট করলো। সেই বাড়িতে কেউ ছিলেন না। জানালার পর্দা একটু তুলে দেখেছি। সব সময় মনে হতো, এই বুঝি কেউ কড়া নাড়বে!

একদিন সত্যি কড়া নাড়া! দরজা খুলেছেন বাবা, পাশেই মা। আমার মায়ের থিওরি ছিল, গেলে তিনজন একসাথে যাবো! দরজায় পাকিস্তানি আর্মি! আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে! কিছুটা পেছনে। উর্দূতে কী যেন বলছে! মা ঘরে গেলেন। হাতে সাদা চাদর নিয়ে আসলেন। কোনো বড় পদের কেউ আসছে তাই তাদের মাহফিলের জন্য চাদর চাইতে এসেছে! মা যে চাদর দিয়েছিলেন তা বিশেষ সুবিধার ছিল না। ওরা কিছু বলেনি।

মা তার কাজের জায়গায় আমাকে নিয়ে যেতেন। প্রতিবার আইডি চেক করতো ক্যাম্পাসের প্রধান গেটে। আমি শক্ত হয়ে রিক্সায় বসে থাকতাম। মনে মনে “কুত্তার বাচ্চা” বলতাম। হ্যাঁ সেই বয়সেই একটি গাল শিখেছিলাম। কুত্তা কোনো গাল নয় তা বুঝেছি পরে। মায়ের অফিস ছিল গার্ল গাইডসের। পাকিস্তানের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না সেই অফিসের। মা প্রচণ্ড সাহসের সাথে রাজাকারদের ট্রেনিং ক্যাম্প সামনের মাঠ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। ব্যবহার করেছিলেন মুসলমানদের ধর্মীয় চিন্তা! নারীদের অফিসের সামনে পুরুষদের ট্রেনিং হয় কীভাবে!

এরপর এক আর্মি অফিসার মায়ের অফিস ভিজিটে আসবে জানতে পেরে (ভাগ্যিস আগে জেনেছিলেন) প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তার সাথে পালিয়ে ছিলেন পাশের পিএন গার্লস স্কুলে। বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আরো একবার বেঁচেছেন বাবা-আমি সহ। বাবা দু’বার বেঁচেছেন এক মামার খোঁজ করতে যেয়ে মরতে মরতে।

প্রতি রাতে সাইরেন বাজতো। কাছেই ইন্ডিয়ার বর্ডার। বম্বিং হতো বর্ডার লক্ষ করে। বম্বিং-এর সময় পুরো বিল্ডিং কাঁপতো। প্রতি রাতে দৌড়ে নিচতলার সিঁড়ি ঘরে আশ্রয় নিতাম বিল্ডিং-এর সবাই। সেই রাজাকারমনস্ক শিক্ষকও পরিবারসহ থাকতেন।

পরে বাবা বলেছেন, আমাকে তিনি চেপে ধরে থাকতেন আর ভাবতেন এই বুঝি আমার হার্টফেইল করে! আমার হার্টবিট না কী এতো বেড়ে যেতো!

একথা সেদিন দীপ্তকে বলাতে ও বলেছে, “মনে হয় এই কারণে তুমি লাউড শব্দ সহ্য করতে পারো না!” আমারও তাই মনে হয়।

শুনেছিলাম আর্মিদের মধ্যে নাকী আগেই একটা কথা রটেছিল, মুক্তিবাহিনী রাজশাহীতে ঢুকেছে (সত্যিকার ঢুকবার আগেই)। তাই তারা পাততাড়ি গুটাতে থাকে। না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো কিছু ঘটতো সেখানেও। এর মধ্যে অবশ্য প্রফেসর হাবিবুর রহমান ও সুখরঞ্জন সমাদ্দার কাকুকে হত্যা করা হয়েছে।

আমাদের কোনাকুনি বিল্ডিং-এর এক বাসায় বিকালে আর্মি অফিসারদের গাড়ি আসতো এক অবাংগালী শিক্ষকের বাসায়। একদিন সকালে আর্মির জিপ এসে থামলো আমাদের বিল্ডিং-এর সামনে। জিপে সেই অবাংগালী পরিবার। নিচ তলার রাজাকার শিক্ষককে নিতে এসেছে। পালাচ্ছে তখন আর্মির সাথে বন্ধুদের নিয়ে।

নিচতলার শিক্ষক মনে হয় আগেই কোথাও গিয়েছিলেন। মনে নেই। তিনি ঐ গাড়ীতে যাননি। আমি যখন বুঝেছি আর্মিরা পালাচ্ছে, বাবার ছাত্ররা (মুক্তি বাহিনী আসছে) আমি বারান্দা থেকেই বাবাকে ডেকে বলতে থাকলাম, “আব্বা, ওরা পালাচ্ছে। ওদের ধর। আটকাও।”

না ওদের কেউ আটকায়নি। রাজাকার শিক্ষকদের কিছু হয়নি।

tania-morshedদু’দিন আগে দীপ্ত আমার কাছ থেকে আবারও জানতে চাইলো ১৯৭১-এর অভিজ্ঞতা। যেটুকু মনে আছে বলেছি। বললো, “ আমি কিসের কমপ্লেইন করবো? তোমার দিন কেটেছে মৃত্যুর আশংকায়। বাবার কেটেছে ভারতের শরণার্থী শিবিরে।”

শুধু বলেছি, তোমার যুদ্ধও কম না। যে কোনো যুদ্ধই শিশুদের, অল্প বয়স্কদের অন্য রকম করে দেয়।

 

শেয়ার করুন: