আমাদের রোকেয়া, আমাদের খুঁজে ফেরা……

Begum Rokeya 1ফেরদৌসি খান: ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন-অগ্রসর হউন! বুক ঠুকিয়া বল মা, আমরা পশু নই। বল ভগিনী, আমরা আসবাব নই; বল কন্যে আমরা জড়াই অলংকার-রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ।….(সুবেহ সাদেক, মোয়াজ্জিন আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩৩৭)

মানুষ হবার মন্ত্র ঘরে ঘরে গিয়ে শেখানোর কাজটি করেছিলেন নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ঊনবিংশ শতাব্দিতে মুসলিম ঘরে জন্ম নিয়ে কুসংকারে আচ্ছন্ন সমাজ এবং বেড়িবাঁধা রাষ্ট্রে তিনি আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।

বাঙালী নারীদের শিক্ষা, মর্যাদা, আত্মসম্মান, আত্মপরিচয়ে পরিচিত করার ক্ষেত্রে রোকেয়ার  সব থেকে বড় অবদান রয়েছে। তিনি  উনবিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন। তাঁর জন্ম ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর এবং মৃত্যু ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর পিতা জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। তাঁর মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়। তাঁর প্রকৃত নাম ‘রোকেয়া খাতুন’ এবং বৈবাহিকসূত্রে তিনি ‘রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’ নামে পরিচিত হন। তৎকালীন মুসলিম সমাজব্যবস্থা অনুসারে রোকেয়া ও তাঁর বোনদের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়নি, তাদেরকে ঘরে আরবী ও ঊর্দু  শেখানো হয়। তবে রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের আধুনিকমনা ছিলেন। তিনি রোকেয়া ও করিমুননেসাকে ঘরেই গোপনে বাংলা ও ইংরেজি  শেখান।

এই শিক্ষাই তাঁকে প্রাথমিকভাবে মানুষ হয়ে ওঠার ভাবনা তৈরী করে দেয়। আর সেই ভাবনায়  মানসিকভাবে সহায়তা করে তাঁর সবথেকে কাছের বন্ধু সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন। ১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের  ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। বিয়ের পর তিনি ‘বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’ নামে পরিচিত হন। রোকেয়া সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০২ সালে পিপাসা  নামে একটি বাংলা গল্পের মধ্য দিয়ে তিঁনি সাহিত্যজগতে পদার্পণ করেন। এরপর থেকে তিনি লিখে চলেন একের পর এক পুরানো সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ গড়ার গল্প।

অন্দরমহলে থেকে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সমাজকে যদি সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় তবে প্রথমেই নারীদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অন্ধ করে রাখলে সেই সমাজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগোতে থাকবে। সেই চিন্তার বহি:প্রকাশ আমরা তার লেখনিতে দেখতে পাই। তিনি লিখেছেন,

‘দেখিলেন ভগিনি! যেখানে অশিক্ষিত চক্ষু কর্দম দেখে, সেখানে শিক্ষিত চক্ষু হীরা-মাণিক দেখে। আমরা যে এহেন চক্ষুকে চির-অন্ধ করিয়া রাখি, এজন্য খোদার নিকট কি উত্তর দিব? বিবেক আমাদিগকে প্রকৃত অবনতি দেখাইয়া দিতেছে- এখন উন্নতির চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য।’- (স্ত্রীজাতির অবনতি, মতিচুর প্রথম খন্ডের দ্বিতীয় প্রবন্ধ, নবনুর-ভাদ্র, ১৩১১)

তিঁনি আরো বলেছেন, ‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য প্রস্থ (সেলাই করিবার জন্যে) মাপেন। স্বামী যখন কল্পনা-সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ নক্ষত্রমালা-বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন সূর্যমন্ডলনের ঘনফল তুলাদন্ডে ওজন করেন এবং ধূমকেতুর গতি নির্ণয় করেন স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনীর গতি নির্ণয় করেন।’…….(অর্ধাঙ্গী, নবনূর, আশ্বিন, ১৩১১)

তিঁনি নারীকে উৎসাহ অনুপ্রেরণা দেবার জন্যে লিখেছেন, পুরুষের সমকক্ষতা’ লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন আমরা লেডী-কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী-ম্যাজিষ্ট্রেট, লেডী-ব্যারিষ্টার, লেডী-জজ-সবই হইব। পঞ্চাশ বছর পর লেডী …..হইয়া এ দেশের সমস্ত নারীকে ‘রানী’ করিয়া ফেলিব। উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা ‘স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারিব না?…..(স্ত্রীজাতির অবনতি, মতিচুর ‍প্রথম খন্ডের দ্বিতীয় প্রবন্ধ, নবনুর-ভাদ্র, ১৩১১)

তাঁর এই উক্তির ভেতর দিয়ে যে স্বপ্ন তিনি গেঁথেছিলেন তার প্রতিফলন আমরা আমাদের আজকের সমাজে দেখতে পাই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা একজন নারী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতা নারী। আমাদের জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরীসহ যুদ্ধ বিমান নিয়ে আকাশে উড়ে বেড়ান বৈমানিক তামান্না, বিমানবাহিনীতে এই প্রথম ক্যাপ্টেন নাজিয়া নুসরাত ও শাহরিনা বিনতে আনোয়ার বিমান উড়ানোর পেশায় যাত্রা শুরু করেছেন, হিমালয় পর্বত শৃঙ্গে চড়ে বেড়াচ্ছেন নিশাত, ওয়াসফিয়া, বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব- ১৪ মহিলা ফুটবল দলের ১৯ জনের মধ্যে ১০ জন যারা ময়মনসিংহ এর কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজিদা, মার্জিয়া, মান্দা, ময়না মানকিন প্রমুখ এরা সবাই নারী।

এছাড়া ওয়াসফিয়া আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত, দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ পর্বত, ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বত, এলবার্সের চূড়া, নেপালের এভারেস্ট,  আইল্যান্ড পিক, মাউন্ট এলব্রুসসহ সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয় করেছেন দেশের স্বাধীনতা ৪০ বছরে দেয়া অঙ্গীকার রক্ষা করতেই । ২০১৩ সালের ২৮ মার্চ ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ  মাউন্ট এলব্রুস রাশিয়ার স্থানীয় সময় সকাল সাতটা ৫১ মিনিটে আরোহণ করে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ান[] । এছাড়াও নারীরা বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্বেও থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরী করেছেন।

১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। এর পাঁচ মাস পর রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল  নামে  মেয়েদের জন্যে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠিত করেন ভাগলপুরে। ১৯৩০ সালের মাঝে এটি হাই স্কুলে পরিণত হয়। স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত ছিলেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সভায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯২৬  সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

১৮৮০ সাল থেকে ২০১৫….পার হয়েছে অনেক বছর, নারীরাও এগিয়েছে সেই সময়ের তুলনায় বর্তমানে।  সমাজ পরিবর্তক, সাহসী, আত্বপ্রত্যয়ী হিসেবে আমরা যেমনটি রোকেয়াকে দেখতে পাই তেমনি করে আমাদের আশেপাশে অনেক নারীকেও খুঁজে পাই। পরিবারের মধ্য থেকে এরা আমাদের পথ পরিদর্শক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন অবিচল।

আমরা আগামী ৯ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালের ‘রোকেয়া দিবস’কে দেখতে চাই নতুন ভাবে। তাঁকে নতুন করে জানার জন্যে খুঁজে বেড়াই নতুন রোকেয়াকে। আমার ঘরে, আমার বাইরে, আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে, রাজনীতিতে, কৃষিক্ষেত্রে, সরকারী কর্মস্থলে এমন মানুষ লুকিয়ে আছেন যারা নি:শব্দে কাজ করে যাচ্ছেন নারীদের সাথে নিয়ে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে। তাঁরা স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দিচ্ছেন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার।

আসুন আমরা এবারের রোকেয়া দিবসে তাঁদের নিয়ে গল্প লিখি। তাঁদের কথা জানাই সকলকে। এই দেশে রোকেয়াদের সংখ্যা যতো বাড়বে ততই ঘুচে যাবে সব অন্যায়-অত্যাচার। এই দিবসে আমরা যেন খুঁজে পাই হাজার রোকেয়ার পরের প্রজন্মকে। আজকের তারুণ্যের দায়িত্ব অগ্রজ রোকেয়াদের শ্রদ্ধাভরে সম্মান জানানো।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.