সাব্বির খান: একজন ঐশী তাঁর অপরাধ স্বীকার করেছেন। তাঁর জন্মদাতা পিতামাতাকে একই সাথে, একই রাতে তিনি খুন করেছেন। বাদীপক্ষ আদালতে প্রমাণ করে দায়মুক্ত হয়েছেন যে, ঐশী হত্যার সময় সুস্থ মস্তিস্কেই শুধু ছিলেন না, এমনকি হত্যার পরিকল্পনাও তিনি সুচারুরূপে আগে থেকেই করে রেখেছিলেন। হত্যার দায় স্বীকার এবং সুস্থ মস্তিস্কে হত্যার প্রমাণসাপেক্ষে একজন অভিভাবকহীন কিশোরী ঐশীকে আইনের পঞ্চপাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিতে আদালতের কোন অসুবিধা হয়নি।
এই রায় কার্যকরের দায় এখন রাষ্ট্রের। অবধারিত মৃত্যু যার হাতে, ঐশী তো তারই মালিকানাধীন! এই রায়ের প্রেক্ষিতে ঐশী যতদিন বেঁচে থাকবেন, রাষ্ট্রের মালিকানাধীন একটি ‘বস্তু’ হয়েই থাকবেন, যার নিজস্বতা বা চিন্তা-চেতনার কোন মূল্যায়ন হওয়ার সুযোগ থাকবে না। ঐশীর একমাত্র ছোট ভাই ছাড়া এজগতে তাঁর জন্য দু’ফোটা চোখের জল ফেলার কেউ আছে কি-না, তা সরাসরি জানা যায়নি। তবে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বাধীন একজন অবধারিত মৃত্যুপথযাত্রী কিশোরীর জন্য একটি জাতির অনুকম্পা যে আজ দ্বিধাবিভক্ত, তা ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান!
যারা সংবাদ মাধ্যমের সাথে জড়িত, তাঁরা একটা কথা প্রায়ই বলে থাকেন যে, News behind the news is the main news! অর্থাৎ খবরের পেছনে যে খবর, সেটাই হচ্ছে মূল খবর। পেছনের বা গভীরের খবরই যদি হয় মূল খবরের উৎসস্থল এবং তা যেমন সর্বক্ষেত্রে আলোর মুখ দেখে না, তেমনি সংঘটিত অপরাধের কথা শোনা গেলেও, অপরাধের উৎসস্থল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিমিরেই থেকে যায়। আইনের ভাষায় এটাকে ‘দায়মুক্তি’-র সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত করলে অত্যুক্তি করা হবেনা।
উচ্চ আদালতে রায়ের বিপরীতে আপিল হয়তো হবে। সেখানে ঐশীর সাজা কমবে অথবা বহাল থাকবে। আমরা জানি যে, মামলায় পক্ষ হয় দুইটি, ‘বাদী এবং বিবাদী’। অথচ মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে বিষয়দু’টি নিয়ে আদালতে অভিন্ন সুরে শুনানি হয়, তাহলো ‘অপরাধ’ ও ‘অপরাধী’।
আর অবাক করে দিয়ে আদালত সর্বোতই অনেকটা একচোখার মত শুধু অপরাধীকেই সাজা দিয়ে থাকেন, ‘অপরাধ’-কে নয়। সামাজিক ও মানবিক অনুশীলনের ক্ষেত্রেও এই প্রক্রিয়া যুগ যুগ ধরে ‘নিয়মের হাত ধরে সংস্কৃতি’-তে পরিণত হয়েছে, যার প্রতিচ্ছায়া দেখা যায় জাতির সার্বজনীন অভ্যস্ততায়, আর মননশীলতায়।
এ কারণেই হয়ত আমাদের দেশে সামাজিক অপরাধগুলো অব্যাহত থাকে দাড়ি-কমাহীনভাবে, যুগ যুগ ধরে।
ব্যতিক্রম হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে, অপরাধীকে সাজা দেয়ার পাশাপাশি অপরাধ ঘটানোর মূল উৎপত্তি স্থল ও নাটের গুরু জামায়াতে ইসলামীর কথা প্রতিটা রায়েই ‘পর্যবেক্ষণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইতিবাচক এবং নিঃসন্দেহে দৃষ্টান্তমূলক।

ট্রাইব্যুনালের রায়গুলোকে আমলে নিলে স্পষ্টতই দেখা যায় যে, ‘শুধু অপরাধী নয়, সংঘটিত অপরাধের উৎপত্তিস্থল ও তার পেছনের যে ‘খল-নায়ক’, তাকেও চিহ্নিত করার সদিচ্ছা আদালত দেখিয়েছেন। এই পর্যবেক্ষণে কারণেই যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতে ইসলামীর বিচারের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে এবং জামায়াত নিষিদ্ধের যৌক্তিক দাবিটিও আলোর মুখ দেখেছে।
আইন মেনে চলার শর্তে কোন শিশু জন্ম নেয় না। কঠিন শাস্তির ভীতি সঞ্চার করে অপরাধ থেকে তাকে দূরে রাখার পদ্ধতিও শিশুতোষ মনের সরল বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তার প্রভাব পড়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের অবকাঠামোতে।
অথচ শাস্তির কঠোরতায় মনোযোগ না দিয়ে, রাষ্ট্র তথা আইনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত অপরাধের শেকড়কে চিহ্নিত করা এবং সর্বোচ্চ মাত্রায় তা প্রতিরোধের উপায় বের করা, যাতে অপরাধের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
‘অপরাধ ও প্রতিকার’, বিষয় দু’টি ভৌগলিক সীমারেখায় ভিন্নতর হয়ে থাকে। একই অপরাধ বাংলাদেশে যেভাবে সংঘটিত হয়, ইউরোপ বা অন্যান্য দেশে হয়ত সেভাবে হয়না। অপরাধের চারিত্রিক অবকাঠামো এক হলেও ক্ষেত্রবিশেষে তার প্রাসঙ্গিকতায় ভিন্নতা থাকাই স্বাভাবিক।
অপরাধ প্রসঙ্গে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও থাকে পার্থক্য। সে কারণে ভৌগলিক সীমারেখার অসম ভাবধারা থেকে বিভিন্ন অপরাধকে তুলনা করাও হয় উচ্চমার্গীয় বোকামীর শামিল। অপরাধ যা-ই হোক, তার প্রতিকারের ভাবনা এবং পুনর্বার ঘটতে না দেয়ার উচ্চভিলাষের চর্চাই ‘অধুনা সভ্যতা’। সে বিচারে আমরা কতটুকু সভ্য, সেটাই হয়ত বিবেচ্য বিষয়!
ঐশীর মামলা এবং এর চুলচেরা আইনী বিশ্লেষণ দেয়ার এখতিয়ার বা যোগ্যতা, কোনটাই আমার নেই। তবে বাংলাদেশের আবহমান পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়ে উৎপাদিত একটি ‘মডেল কেস’ হিসেবে মামলাটির ব্যাপারে আলোচনা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। ফৌজদারি আইনের বিধিবিধানকে সমুন্নত রাখতে অন্য আরো দশটি হত্যা মামলার মত ঐশীর মামলাটিও শুরু থেকে শেষ হতে দেখেছি। পাশাপাশি বিশেষ আইনে যুদ্ধাপরাধীদের মামলার রায়ও আমরা দেখেছি। এছাড়াও শত শত ফাঁসির রায় দেখেছি, যেখানে অপরাধ ও অপরাধীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট শুধু ভয়াবহ-ই নয়, একই সাথে অমার্জনীয়।
জাতির পিতার হত্যাকারী সৈয়দ ফারুক রহমান, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মোহাম্মদ বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদের ফাঁসি দেখেছি। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মুহম্মদ মুজাহিদীনের ফাঁসি দেখেছি। ১১জন তরুণীকে ধর্ষণের পর খুন করা শতাব্দির ঘৃন্যতম খুনী রসু খাঁর ফাঁসি দেখেছি। অসংখ্য খুনের আসামী আবুল হাসনাত কামাল ওরফে গাল কাটা কামাল, অর্ধশতাধিক খুনের আসামী শহীদুল ইসলাম শহীদ ওরফে ‘ডাকাত শহীদ’, পেশাদার খুনী নাজমুল হাসান বাবু ওরফে ‘ব্যাঙ্গা বাবু’ সহ শত শত খুনের আসামীর ফাঁসিও আমরা দেখেছি।
প্রতিটা খুনের পেছনে সুস্পষ্ট কারণ, রাজনৈতিক ও সামাজিক নোংরা উদ্দেশ্য ছাড়াও বিভিন্ন স্বার্থজনিত খতিয়ানের কথাও আমরা জেনেছি। অথচ এসব দাগী, কুখ্যাত, ঘৃণ্য, পেশাদার খুনীদের পাশে ঐশীর নামটি ‘খুনী’ হিসেবে লিখতে বিবেকে বাঁধে। আদালতের রায়ে ঐশী নির্দোষ না হলেও, তার খুনী হওয়ার পেছনে যে কারণগুলো, তা আমরা জানতে পারিনি।
পেশাদার খুনীদের মত একই মঞ্চে, একই দড়িতে হয়ত অচিরেই ঐশীর ফাঁসি হবে। প্রতিষ্ঠা পাবে আইনের শাসন। তবে বিবেক যদি জানতে চায়, ‘সুশাসন ও সুন্দর জীবন’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সোনার বাংলার স্বপ্ন আমরা সেই একাত্তর থেকে দেখেছি, তার কী হবে?
ঐশীর ফাঁসি কি প্রজন্মকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারবে? সোনার বাংলা গড়ার যে মূল চারটি স্তম্ভ, বিচার বিভাগ তাদের মধ্যে অন্যতম। ঐশীর ফাঁসির আদেশে সমস্যার যে সমাধান আদালত দিয়েছেন, তাতে অপরাধের উৎপত্তি স্থল খোঁজার কোন ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। হয়নি ভবিষ্যত ঐশীদের রক্ষার জন্য আগাম প্রতিরোধমূলক সুচিন্তিত কোন ‘পর্যবেক্ষণ’ বা ‘আদেশ’।
এধরনের রায়গুলোতে সাধারণত রাষ্ট্র বেঁচে যায়, পতিত হয় অসহায় পরিবারগুলো। গবেষকরা জানার সুযোগই পায় না, কি কারণে ঐশীরা খুনী হয়! যুগান্তরের এ প্রক্রিয়া ও অনুশীলনের কারণে কার্পেটের নিচে যে ময়লা জমে, তা পরিস্কারের দায় যদি নেয়া হতো, তাহলে প্রজন্ম নিঃসন্দেহে উপকৃত হতো।
গাণিতিক সমাধানের মতো ঐশীর দাঁত গুনে বয়স নির্ধারণ হতে দেখেছি। বখে যাওয়া ঐশীর ইয়াবা সেবনের কথাও গোপন থাকেনি। ঝানু তদন্ত অফিসাররা খুনের চাকু-বটি উদ্ধার ছাড়াও ফরেনসিক রিপোর্টের সাহায্যে প্রমাণ করছেন যে, ঠাণ্ডা মাথায় এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ঐশী তার পিতামাতাকে খুন করেছেন।
অথচ অবাক করে দিয়ে আদালতের একজন মানুষও গভীরের অনুন্মোচিত কারণগুলোর কথা উচ্চারণ করেননি। “কোন কারণে বা স্বার্থে ঐশী খুনী হলো, এ দায় কার, এর প্রতিকার কি, দেশে কিশোর অপরাধ কেন বাড়ছে, এসবের ইন্ধনদাতা কারা”-প্রশ্নগুলোর উত্তর আঁধারেই রয়ে গেল।
রায়ের পর্যবেক্ষণে কোথাও উল্লেখ হলো না, ‘এ অপরাধের দায় রাষ্ট্রের, এব্যর্থতা সমাজের বা পরিবারগুলোর’। কেউ একটি বারের জন্য ভাবলেন না, যে কারনগুলোর জন্য আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র একজন খুনী ঐশীর জন্ম দিল, ভবিষ্যতে ঐশীর পরেই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে আমাদেরই সন্তান, ভাইবোন বা প্রতিবেশিরা। আক্ষেপ হয় ভেবে, ‘আদালত কি শুধুই জটিল ভাষায় লেখা আইনানুগ কিছু সমাধানের পৃষ্ঠপোষক?’ আদালত বিবেকহীন হতে পারে না, এভাবনাকেই সভ্যতা বলে মনে করি। ঐশী-মামলায় আইনের অনুশীলন হয়েছে; বিবেকের নয়!
আইনের চোখে ঐশী মোটা দাগের একজন খুনী হলেন ঠিকই, কিন্তু সেই সাথে প্রাণ পেল ‘গভীরের অপরাধীরা’, যাদের রুখতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রের অবকাঠামোগুলো। ঐশী হয়ত উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন। সেখানে কি হবে তা আগাম বলা অসম্ভব। আমাদের বিশ্বাস করা উচিত, যদি তাঁর ফাঁসি রায় বহাল থাকে, তাহলে তার মৃত্যু আমাদের পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য আলাদা কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। পক্ষান্তরে সে রায় হবে সবার ‘দায়মুক্তির রায়’।
আমাদের বিশ্বাস করা উচিত, আজ জীবদ্দশায় ‘মৃত যে ঐশী’ কারাগারে আছেন, সরকার তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের জন্য সে অবশ্যই একটি মূল্যবান সম্পদ। প্রজন্মের প্রতিনিধি মৃদুভাষী জীবন্ত ঐশীর মাঝে লুকিয়ে আছে বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক অবক্ষয়, অন্যায়, অসুন্দর আর অপরাধ জগতের বিবিধ প্রশ্নের অজানা উত্তরগুলো। ভবিষ্যতে সতর্ক হওয়ার জন্য উত্তরগুলো সমাজবিজ্ঞানী, সরকার এবং আমাদের পরিবারগুলোর জানা অত্যন্ত জরুরী। আমাদের শুধরাতে হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে পরিবারের তৃণমূল পর্যন্ত।
কোন পরিবারই ‘ঐশীদের’ হারাতে চায় না। অন্ধকারের চোরাগলিগুলো চিনে নিতে আগামীর ঐশীদের সুযোগ দেয়া উচিত। ফাঁসির আসামী ঐশী আমাদের সেকাজে সহযোগিতা করতে পারেন। ঐশীই পারেন প্রজন্মকে আলোর পথের সন্ধান দিতে!
চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নয়নে মরোণোত্তর দেহদান যেমন একটি ‘মানবিক’ সিদ্ধান্ত, তেমনি রাষ্ট্রের কাছে বিনীত প্রার্থনা-“এদেশের কোটি কোটি তারুণ্যকে রক্ষার লক্ষ্যে একজন জীবিত ঐশীকে দান করা হোক সমাজ গবেষকদের হাতে। মানবিকতার প্রশ্নেই শুধু নয়; মনস্তাত্বিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের শেকড় উন্মোচনে গবেষণার স্বার্থে ঐশীকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরী।
যে অবক্ষয় ঐশীর মত হাজার হাজার তারুণ্যকে অপরাধ ও অন্ধকার জীবনে উৎসাহিত করছে, তার কারণ ও ধরনগুলো আমাদের জানা দরকার, যা ঐশীর সহযোগিতায় মনো-ও সমাজবিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করতে পারেন। ভুলের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী করণীয়গুলো স্থির করার সুযোগ পাওয়া সভ্য সমাজের অধিকার।
একজন ঐশীকে ফাঁসির মাধ্যমে রাষ্ট্র, সমাজ তথা পরিবারের দায়মুক্তি দেয়ার যে সংস্কৃতি, তা পরিহার করা উচিত। সোনার বাংলাদেশ গড়ার মূলমন্ত্র হোক আমাদের সততায়-সভ্যতায়; অনৈতিক অবক্ষয়ে নয়!
লেখকঃ বিশ্লেষক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক
ইমেইলঃ sabbir.rahman@gmail.com