নাহিদ শামস্ ইমু: মাত্র কয়েক মাস আগের কথা। আমি ছিলাম চট্টগ্রামে। কোনো এক বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছি একজন বন্ধুর অপেক্ষায়। সড়কটি মোটেও নিরিবিলি নয়, বেশ ব্যস্ত। এমন সময় আমার থেকে মাত্র দু’হাত দূরত্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক পাঞ্জাবি পরিহিত অপরিচিত ছেলের, বয়স বিশ কি বাইশ, ফোনালাপ শুনতে পেলাম। সে সম্ভবতঃ কথা বলছিলো তার কোনো এক স্থানীয় বড় ভাইয়ের সঙ্গে। কথোপকথনের চুম্বক অংশটি নিম্নরূপঃ
“ভাই, গাঞ্জা-টাঞ্জা লাগলে আজকে রাতে পাঠাই দিতে পারবো।… হ্যা, বিদেশী মদ তো অ্যাভেইলেবল আছে। (খানিক বিরতির পর)… ইয়াবা তো এখন পারবো না। কাল-পরশুর মধ্যে ইয়াবা ম্যানেজ করা যাবে!’
ছেলেটির ফোন কনভার্সেশন শুনে আমি একধরনের আতঙ্ক অনুভব করলাম। এরই মধ্যে আমার সেই বন্ধুটি এসে পড়ায় আমি তার দিকে ফিরে কুশল বিনিময় করতে শুরু করি। খানিক পরে পাশ ফিরতেই তাকিয়ে দেখি, সেই ছেলেটি উধাও! প্রথমেই আমার যেটা মনে হয়েছিলো, ছেলেটা প্রকাশ্য দিবালোকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খুব স্বাভাবিক গলায় গাঁজা এবং ইয়াবার মত ভয়ংকর বিষয় নিয়ে কথা বলার সাহস পেলো কি করে? উত্তরটা অনুমেয়। ছেলেটি জানে, তার কিছু হবে না। কেউ তার কিছু করতে পারবে না।
একটু অন্যভাবে বলা চলে- ‘কেউ তার কিছু করবে না’। ইয়াবা নিয়ে তাই লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলবার প্রয়োজন পড়ে নি তার, মুখ ঢেকে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে হয় নি তাকে। যে দেশে স্যানিটারি ন্যাপকিনের মত একটি স্বাভাবিক এবং অতি প্রয়োজনীয় জিনিসের কথাই নারীরা কোনো এক বিচিত্র কারণে মুখ ফুটে বলতে লজ্জা বোধ করেন, সে দেশে ‘নিষিদ্ধ’ ও ভয়াবহ নেশা সৃষ্টিকারি ইয়াবা এবং গাঁজার কথা প্রকাশ্যে, ব্যস্ত সড়কে উঁচু গলায় কেউ বলতে পারছে- এটা নিঃসন্দেহে অস্বস্তিদায়ক!
শুধু এই একটি ‘তুচ্ছ’ ঘটনা থেকেই আমার মনে হয়েছিলো, আমাদের সমাজে গাঁজা কিংবা ইয়াবার মত মাদক সেবন ও ব্যবসা’র ঠিক কী পরিমাণ বিস্তৃতি ঘটেছে! এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, মাদক ব্যবসায়ীদের নেটওয়ার্ক বিস্তারের সঙ্গে প্রশাসনের আঁতাত বা যোগসাজশ থাকাটা অত্যাশ্চার্য নয়! আমরা সবাই এ কথা জানি, তবুও কেউ তা স্বীকার করবো না!
ঐশী নামের একটি কমবয়সী ইয়াবা আসক্ত মেয়ে তার বাবা এবং মা’কে খুব ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছিলো, খবরটি এক বছর আগেই আমাদের কানে এসেছে। একটি মেয়ে তার মা এবং বাবা’কে হত্যা করতে পারে, এটা আমার কাছে এখনও অবিশ্বাস্য। খবরটি শোনার পরই মেয়েটির মানসিক বিকারগ্রস্ততার ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ হয়নি।
ক্রমাগত নেশা এবং মাদক গ্রহণ স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষের ভেতর তীব্র মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা তৈরি করে ফেলে। পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ঘৃণিত আসামীটির পক্ষেও নিজের বাবা এবং মা’কে একই সঙ্গে হত্যা করা কঠিন! কাজেই এই কাজটি যদি কেউ করে থাকে, সে নিঃসন্দেহে সুস্থ মস্তিষ্কে ছিল না- এটা বুঝবার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হবার প্রয়োজন পড়েনি। ঐশী নামের এই কমবয়সী মেয়েটি সেই ভয়ানক কাজটি করে প্রমাণ করে দিয়েছে যে মানসিকভাবে সুস্থ নয়।
এই খুনটি করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কিন্তু আমি বা আপনি হননি; হয়েছে ঐশী নিজেই; সে পৃথিবীতে তার সবচেয়ে আপন দু’জন মানুষকে হারিয়েছে। এবং তার এই মানসিক অসুস্থতার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে মাদক, এবং তার মাদকসেবী বন্ধুরা! ঐশীর জন্য সব থেকে বেশি জরুরি ছিলো একটি মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট। ইয়াবার প্রভাব থেকে তাকে মুক্ত করা, অপরাধ প্রবণতা হ্রাস, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার একটি উন্নত চিকিৎসা প্রদান করা। হ্যাঁ, ঐশী একটি ঘোর অপরাধ করেছে। সে জন্য তাকে কারাদণ্ডেও দণ্ডিত করা যেতে পারতো, সেখানেও তার চিকিৎসা করানো যেতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ সেটি হয়নি, তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আমরা সবাই জানি, মাঝখান থেকে বেঁচে গেছে মাদক ব্যবসায়ীরা, বেঁচে গেছে প্রশাসনের হর্তা-কর্তা এবং গডফাদাররা। যারা মাদক ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছে, যারা ঐশীদের হাতে মাদক তুলে দিয়েছে তাদের কোনো শাস্তি হবে না আর!
তবে আরেকটা কথা খুব বলতে করছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে ঘৃণিত নরপশু ও কসাই-বাহিনী রীতিমত জবাই করে, গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিলো সহস্রাধিক বাঙালি, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এ দেশের নারীদের ওপর, মহোল্লাসে যারা আগুনে ধরিয়ে দিয়েছিলো নীরিহ মানুষের গৃহে, লুটপাট করেছিলো নিঃসংকোচে, যারা এ দেশকে এবং এ দেশের মানুষকে স্রেফ ধর্ষণ করেছিলো- তাদের ফাঁসির আদেশ দেয়া মাত্রই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল থেকে নানা-রকম চিঠি-পত্র আসে! সে সব চিঠিতে ফাঁসি কার্যকর না করবার অনুরোধ থাকে। সে সব চিঠিতে তাঁরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন, আমাদের মানবতা’র পাঠ দান করেন, আমাদেরকে শেখান- ‘একটি হত্যার বিচার করতে গিয়ে আরেকটি হত্যা করা উচিত নয়। এটি মানবতা লঙ্ঘন।’
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, ঐশীর ফাঁসির আদেশের পর কয়টা চিঠি এসেছে?