ঐশী নাকি ইয়াবা?

Oishee 4জাহিদ নেওয়াজ খান: মৃত্যুর পর যে জীবন, ওই জীবন থেকে ঐশীকে দেখে, কারাগারে ঐশীর যে কষ্ট সেই কষ্ট অনুভব করে, এখন ঐশী মৃত্যুদণ্ডের আদেশ পাওয়ার পর তার মা-বাবার হৃদয়ও নিশ্চয়ই এভাবে কেঁদে উঠছে। মেয়ের সামান্য কষ্টও হতে পারে এমন কিছু তারা কখনও কল্পনাও করতে পারেননি। সন্তানের সুখের জন্য ঠিক-বেঠিক সব পথেই ছুটেছেন ঐশীর বাবা। অন্য যে কোনো মা-বাবার মতোই সাধ্যমতো সবচেয়ে ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেছেন, বাজারের সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি কিনে দিয়েছেন, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সেরা স্কুলগুলোর একটিতে ঐশীকে পাঠিয়েছেন, হয়তো মেয়ের ভবিষ্যতের জন্য প্লট-ফ্ল্যাটও কিনে রেখেছেন তারা।

আর বৈষয়িক কোনো কিছু না করে থাকতে পারলেও তাদের ভালোবাসার সবটুকু তারা দিয়েছেন ঐশী আর তার ছোটভাই ঐহীকে। সেই ভালোবাসার এক সন্তান আজ তাদের হন্তারক! মা-বাবা দুইজনকে হত্যার জন্য দুইবার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ! কতোটা দুর্ভাগ্যের হলে এমন হতে পারে মানুষের জীবন!

ঐশী তার মা-বাবাকে খুনের মতো চরমতম অপরাধ করে ফেলার কারণে এখন ঐশীর নাম আসছে বারবার। কিন্তু ঐশীর মতো মানসিক সমস্যায় পড়া মেয়ে এবং ছেলে এখন ঘরে ঘরে। চরমতম ঘটনাটি হয়তো ঘটছে না, কিন্তু কাছাকাছি সমস্যায় আছে অনেক পরিবার। কিন্তু কেনো এই অবস্থা?

ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র থেকে সমাজ; সমাজকে জবাবদিহিহীন করেছে সবাই। এর সঙ্গে গলিত রাজনীতিতে এক আধা-খেঁচড়া পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কাঠামো আমরা গড়ে তুলেছি যেখানে সন্তানদের এমনভাবে বড় করছি যাতে তাদের মধ্যে ব্যক্তি ভোগবাদটাই মুখ্য হয়ে উঠছে।

স্কুল-বাসা আর বাসায় কম্পিউটার-ইন্টারনেট-ভিডিও গেইমস-টেলিভিশন ছাড়া জীবনের প্রকৃত অর্থের আর কোনো দরজা-জানালাই আমরা খুলে দিতে পারছি না, যেখানে প্রথম সুযোগেই তাদের কাছে নতুন জানালায় জীবনের মানে হিসেবে দাঁড়াচ্ছে ইয়াবা কিংবা কোনো ড্রাগস, অথবা জীবন দর্শনের অনুপস্থিতিতে জঙ্গিবাদ।

পত্রপত্রিকা, অনলাইন আর টেলিভিশনের সংবাদে বোঝা যায়, শুরুর সেই গল্পের মেয়েটির জন্য ছেলেটির ভালোবাসার মতো ঐশীর সামনে ভালোবাসা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলো ইয়াবা এবং তার ইয়াবা-আসক্ত বন্ধুগোষ্ঠি। প্রেমিকার ভালোবাসা পেতে ছেলেটি মায়ের হৃদপিণ্ড ছিন্ন করে নিয়েছিলো, আর এখানে ঐশী তার মা-বাবার। স্কুল-কোচিং-প্রাইভেটের জীবনে হয়তো ঐশী জীবনের প্রথম আনন্দ পেয়েছিলো ইয়াবাতেই। সেখান থেকে ঐশীকে আর ফেরানো যায়নি।

তবে জীবনের প্রকৃত অর্থ আর আনন্দ থেকে বঞ্চিত ঐশীদের সংখ্যা অনেক। ঘরে ঘরে আছে এমন অনেক ঐশী। কেউ মেয়ে ঐশী, কেউ ছেলে; কেউ ড্রাগ অ্যাডিক্ট, কেউ ড্রাগস ছাড়াই মানসিক নানা সমস্যায় আক্রান্ত।

আমরা আমাদের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য, বৈধ-অবৈধ যেভাবে পারি শুধু ব্যাংক ব্যালান্সের স্বাস্থ্য বড় করার চেষ্টা করছি, ছেলে-মেয়েরা যেনো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে সেজন্য নামে-বেনামে প্লট-ফ্ল্যাটের মালিক হচ্ছি, কথিত ভালো মা-বাবা হওয়ার চেষ্টা হিসেবে সন্তানদের শুধু ভালো রেজাল্টের জন্য স্কুল থেকে কোচিং, কোচিং থেকে প্রাইভেট আর প্রাইভেট থেকে পড়ার টেবিলে বস্তা বস্তা বই-খাতা দিয়ে তাদের মাথা ভারী করে দিচ্ছি। কিন্তু যে ভালোবাসার যক্ষের ধনের জন্য এতোকিছু তার মনের খবর রাখছি না, তার মানসিক শান্তি, স্বস্তি আর বিকাশের জন্য একটুও ভাবার চেষ্টা করছি না।

ফল হিসেবে একটু বড় হয়ে, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে স্বাধীনতার প্রথম সুযোগেই কেউ ইয়াবায় আসক্ত হচ্ছে, কেউ ফেন্সিডিল অথবা হেরোইন কিংবা অন্য কোনো ড্রাগসে। আবার শূন্যতার এ জীবনে কেউ কেউ জীবনের মানে খুঁজে পাচ্ছে জঙ্গিবাদি আহ্বানে সাড়া দিয়ে জঙ্গি হয়ে অথবা জঙ্গিবাদি চেতনাকে ধারণ করে মানসিক রোগী হয়ে। ছোটবেলায় তারা এমন জীবন দর্শন পাচ্ছে না যে দর্শন তাকে বোঝাবে পরকালের ভয় কিংবা লোভে নয়, নৈতিক আদর্শে জীবন গঠন জীবনেরই দায়।

এক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র দিয়ে মানসিক উৎকর্ষ কার্যক্রম চালিয়ে কতোজনকে আলোকিত করবেন! কোথায় আমাদের ছোটবেলার খেলাঘর, কোথায় কচিকাঁচার আসর, কোথায় চাঁদের হাট, কোথায় মুকুল ফৌজ! কোথায় আমাদের ছোটবেলার মতো মহল্লায় মহল্লায় ক্লাব-লাইব্রেরি! কোথায় আমাদের শাহীন ভাই-কাজী ভাইয়ের মতো সামাজিক বড় ভাই, যাদের হাত ধরে পরিবারের বাইরে জীবনের প্রথম সহজ পাঠ!

যেদিন থেকে এই সামাজিক বড় ভাইরা হারিয়ে যেতে শুরু করেছেন, সেদিন থেকেই আমাদের শিশুদের জীবন শুধু বাসা-বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, বড়জোর বাড়ির ছাদ কিংবা পার্কিংয়ের সামান্য খোলা জায়গা। এ সামাজিক ভাইদের রাজনৈতিক বড় ভাইরা হটিয়ে দিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে কোনো মহল্লার এখন পরিচিত বড় ভাই মানে মহল্লার সবচেয়ে খারাপ ছেলেটি, যার রাজনৈতিক পরিচয় আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি। এরা সকল অনাচারের সঙ্গে মহল্লায় মহল্লায় ড্রাগস নিয়ে এসেছে, একেকজন ড্রাগস লর্ড হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, নিজেদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠায় হয় সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙ্গে দিয়েছে অথবা সেগুলোর দখল নিয়েছে। তাদের এরকম দাপটে হারিয়ে গেছেন সেই বড় ভাই যারা ঐশীর মতো লাখো ছেলেমেয়েকে জীবনের আলোর সন্ধান দিতে পারতেন।

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের এমন প্রভাব থেকে সমাজকে রক্ষায় রাজনৈতিক শক্তির মাথা-ব্যথা থাকার কথা নয়, কিন্তু সামাজিক শক্তিগুলোরও কোনো সাহস নেই। আবার আগে যেমন ইত্তেফাকের মাধ্যমে কচিকাঁচা আর সংবাদের মাধ্যমে খেলাঘর তার কার্যক্রম চালাতো, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সেই দায়িত্ব নেয়ার সুযোগ ছিলো। কিন্তু এরকম সুস্থ চিন্তা করার মতো সময় কই তাদের! ভারতীয় চ্যানেলগুলোর অন্ধ এবং ব্যর্থ অনুকরণে তারা তো ব্যস্ত নিজেদের পকেট ভারী করে কতো দ্রুত একটি ভবিষ্যত প্রতিভাকে নাচে-গানে ঝলমলে দুনিয়ার হাতছানিতে নষ্ট করে ফেলা যায় সেই মহান মিশনে।

তবে শুধু টেলিভিশনেই নয়, আধা-খেঁচড়া পুঁজিবাদী জীবন ব্যবস্থায় কোথাও এখন আর সমষ্টি নিয়ে ভাবার সময় নেই, সবাই দুয়েকজন কথিত স্টার খোঁজার মিশনে ব্যস্ত, ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে ভাবার সময় রাষ্ট্র এবং সমাজ কারোরই নেই।

তবে ঐশীর ঘটনায় সময়টা এখন শুধু ব্যক্তিক আর বৃহত্তর জীবনে দোষারোপের জন্য নয়। ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রিয় জীবনে অস্থিরতার কারণে নতুন প্রজন্মের যে এক ধরনের স্থায়ী কষ্ট, সেই কষ্ট দূর করতে না পারলে নতুন প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্য গঠন সম্ভব হবে না। আর তাহলে আরও নেতিবাচক সমাজ গড়ে উঠবে এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রে।

ইট-কাঠ-কংক্রিটের শহরে আমাদের মনও রড-সিমেন্ট দিয়ে গড়ে উঠছে, যেখানে মাঠ না থাকার মতো সবুজও অনুপস্থিত। আমরা কি আমাদের হৃদয় হারাতেই থাকবো, নাকি ঐশীদের রক্ষায় নতুন বিনির্মাণের কথাও ভাববো? সে কথা ভাবার সময় এসেছে। ঐশীর ঘটনা কি জাগরণের ডাক হবে?

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.