উচ্চ শিক্ষিত মুসলিম নারী ও ভারতের মুসলিম বিবাহ প্রতিষ্ঠান

Sarita
সারিতা আহমেদ

সারিতা আহমেদ: ছোটবেলায় ‘বাপুরাম সাপুড়ে ‘ নামের একটা কবিতা ছিল ,খুব আউড়াতাম আর খিল খিল কাটাতাম মেয়েবেলা । বড় হয়ে যখন বুঝতে শিখলাম, তখন খেয়াল করে দেখলাম বাপুরামের নিতান্ত নির্বিষ ‘ভালো মানুষ’ সাপেদের মতই আমাদের সমাজ মেয়েদের দেখতে চায়, পেতে চায়, ছুঁতে চায়।

বর্তমান ইঁদুর দৌড় সমাজে বেশীর ভাগ মধ্যবিত্তের নিউক্লিয়ার পরিবার। একটা বা দুটো সন্তান। তাদের বাবা মা কিন্তু মোটামুটি সমতা রেখেই ছেলে বা মেয়ে ‘মানুষ’ করেন। মেয়েকে ভাল স্কুলে ভর্তির লাইন দিতে রোদে পুড়ে জলে ভিজে চাতকের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন পিতামাতা । এটা খুব স্বাভাবিক ছবি ।

শিক্ষা, যে কোনো জাতির উন্নতির প্রধান ও একমাত্র চাবিকাঠি , যার কোনো ব্যতিক্রমী রাস্তা বা শর্টকাট হয় না ।

একটা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে যেমন কঠোর পরিশ্রম করে, মেধার পরীক্ষা দিয়ে নিজের যোগ্যতায় চাকরি পায় , জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়; একটা মেয়েও ঠিক তেমনিভাবেই জীবনের নানা বাঁক পেরিয়ে নিজের পরিচয় বানায় । বরং মেয়েদের চলার , হাঁটার বা দৌড়ানোর পথটা কাঁটায় মোড়া থাকে বেশী করে ।

হয়তো তাকে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে অত প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয় না, কিন্তু মূল বাধাগুলো পেরোতে হয় বাড়ির বাইরে। কর্মভূমিতে । শিক্ষার্থির ক্ষেত্রে শিক্ষালয়ে , চাকুরিরতার ক্ষেত্রে চাকুরিস্থলে । কখনো তা অসাধু ফাঁদের হাতছানি হিসেবে আবার কখনো প্রতারণা বা শারিরীক হেনস্তা হিসেবে একটা কর্মঠ মেয়ের জীবনে আসে ।

এ পর্যন্ত সবই চেনা ছক  প্রায় সব শ্রেনীর, সব ধর্মজাতির ক্ষেত্রে। কিন্তু ছকটা একটু বদলায় , মুসলিম সমাজে । মেয়ের ২৩+ বয়েসের পরে ।

উচ্চশিক্ষা, উচ্চতর শিক্ষায় একের পর এক যোগ্যতা প্রমান দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে, নিজের পায়ের তলার জমি পেতে একটা ছেলের ঠিক যতগুলো বছর সময় লাগে , একটা মেয়েরও ঠিক ততগুলো বছরই লাগে । এতগুলো পথ পেরিয়ে সমাজে উভয়ই সমানপদের পরিচিতি পায় সম্পূর্ণ নিজ মেধা-শ্রম ও কর্মের যোগ্যতায় । আজকের তারিখে দুজন এডাল্ট সহাবস্থানের সিদ্ধান্ত নিলে তাতে উভয়েরই সমান অবদান ( contribution) লাগে , মানসিকভাবে, শারিরীকভাবে এবং আর্থিকভাবে । শেষেরটা কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা অঙ্গ , একে হাজার বোহেমিয়ান সত্ত্বা দিয়েও অস্বীকার করা যাবে না ।

কিন্তু ভারতের বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থায় দেখা যাচ্ছে মুসলিম পরিবারে উচ্চশিক্ষায় যত মেয়েদের অংশ বাড়ছে তত কমছে তাদের ভবিষ্যৎ ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর আশা । 

কেন ?

Draupodi 1কারণ , আজও ভারতের শিক্ষিত ‘মডারেট’ মুসলিম পরিবার, ছেলের বৌ হিসেবে পাত্রীর শিক্ষাগত ধীশক্তিগত যোগ্যতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে , নামাজ শিক্ষা- কোরান জ্ঞান- রোজা রাখার অভ্যাস – ইসলামিক রীতিনীতি ইত্যাদি ।

সম্প্রতি হায়দরাবাদে এক ঘটক ( city match maker ) শাহিদ ফারুকি-র অভিজ্ঞতায় ধরা পড়েছে ২৩ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে বয়েস এমন উচ্চশিক্ষিত ( M.A, B.Ed , M.Ed, M.Com, B.Tech , M.Tech ) পাত্রীদের জন্য যোগ্য সুপাত্র মিলছে না ।

তাঁর কথায় , ” it’s become a herculean task to find these educated women, equally qualified grooms. Seven out of 10 women seeking alliances these days are well educated. Given that several men aren’t still particularly interested in a girl’s education (many aren’t qualified themselves) and pay more attention to her looks and financial status, it’s getting difficult to find these prospective brides an appropriate match.”

আর এজন্য এই সব মেয়েদের একটা “compromise” করতে হচ্ছে ।

কি সেটা ?

তা হল, উচ্চশিক্ষিত এইসব মেয়েদের বিয়ে করতে হচ্ছে স্কুল ড্রপ আউট , ১২ ক্লাশ ফেল , আন্ডার গ্রাজুয়েট ছেলেদের । যাদের হয়তো পরিচিতি এলাকার ছোটখাট ব্যবসাদার হিসেবে।

এক ডাক্তার মেয়ে নানা বিবাহ সংক্রান্ত ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে সন্ধান চালাচ্ছেন যোগ্য পাত্রের এবং হতাশ হচ্ছেন ।

ভারতের বিখ্যাত ম্যারেজ সাইট Shaadi.com এর একজন আধিকারিক যোগীতা তাঁর অভিজ্ঞতায় বলছেন , “”If a man earns well, families overlook his qualification. Mostly, it’s the women who end up compromising.”

Osmania University র অধ্যপক এবং নানা শিক্ষাবিদরা এটাকে মেয়েদের উত্থান বা একটা ‘সাইলেন্ট রেভ্যুলিউশন’ নামে ডাকছেন ।

এ বিষয়ে একদল তদন্তকারী জানাচ্ছেন এটা এমন একটা দ্বন্দ্ব যাকে বলা যায়  “transitional issue” ! তাদের ভাষায় “”Thanks to schemes like free education and fee reimbursement, there are an increased number of girls who are enrolling for higher studies now. Even the drop-out rate among them has lowered. While this has narrowed the educational gap between boys and girls, such issues (related to marriage) have cropped up.”

জালিশা সুলতানা ইয়াসিন , member of the Muslim Women Intellectual Forum বলেন : “There was a lot of insecurity among women until a few years ago and they took to education to support themselves. But that brought along a lot of practical problems which we need address to correct this imbalance. Parents need to push male children to study to resolve this “

অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না ।

যেখানে ভারতে পুরুষ এবং নারীর লিঙ্গানুপাত = পুরুষ : নারী > ১০০০ : ৯৪০ ( ২০১১ আদমশুমারী অনুযায়ী )

Crocodile tearsআর শিক্ষাক্ষেত্রে যেখানে মাত্র ৭৪% ভারতবাসী শিক্ষিত , তার ৬৫.৫% হল নারী এবং ৮.৫% হল পুরুষ । ( ২০১১ রিপোর্ট )

এ যেন এক উলোট পুরাণ !!

মুসলিম সমাজের হাল আরও খারাপ , বলাই বাহুল্য ।

কিন্তু সবই কি শুধুমাত্র ‘পিছিয়ে পড়া জাতি’ বলেই ? নাকি পিছিয়ে পড়া মানসিকতার জন্যও অনেকটা ।

বস্তুতই মুসলিম সমাজ প্রতিদিন ১০০ বছর করে পেছোচ্ছে দাড়ি- টুপি, হিজাব, বোরখা আর জেহাদের কট্টরতায় । একটা গোটা সমাজ মূলধারার শিক্ষার আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নানা রাজনৈতিক ধার্মিক নিম্নগামীতার কারণে ।

কাগজের বিজ্ঞাপণে দেখা যায়,

শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত চাকুরিজীবি মুসলিম যুবাদের একটা বড় অংশ স্ত্রী হিসেবে আজও কামনা করে ১৮- ২৩ এর পুতুল পুতুল শো-কেস বেবি ,যার জীবন কাঠি থাকবে অন্তত ১০ বছরের বেশী বড় স্বামী নামক কর্তার হাতে । সেই জীবন চাবি ঘুরিয়ে যখন খুশী দম দিয়ে স্ত্রীটিকে উঠানো -বসানো -শোয়ানো -বাচ্চা বিয়ানো ইত্যাদি নানা জৈবিক কাজ করানো যাবে , ইসলাম সম্মত ভাবে।

অথবা,

আরেকদল শিক্ষির ‘মডারেট’ শ্রেনীর চাহিদা অনুযায়ী এমন পাত্রী চাই যে হবে,

চাকরীওয়ালা -নামাজি -চটপটে ইংলিশ বলা-হিজাবী এক আজব ‘অল-রাউন্ডার’ ! যার টাকা উপার্জনের ক্ষমতা থাকবে নিজ যোগ্যতায় ; কিন্তু খরচের অধিকার থাকবে স্বামীর আয়ত্বে । ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হবে জয়েন্ট;  কিন্তু ATM , Pin থাকবে স্বামীর জিম্মায় । এক অদ্ভূত মিথোজীবিয় পরজীবিতা !

বাবুরাম সাপুড়ে-র কাছে ঠিক যেমন এক নির্বিবাদি সাপের আশায় ছড়া লেখা হয়েছিল , এও যেন ঠিক তেমনি চাওয়া । মেয়ে ছাড়া যেহেতু বাচ্চা হবে না , তাই বংশবিস্তারও সম্ভব না । সেহেতু বিয়ের জন্য পাত্রী চাই । কিন্তু ওই…

যে পাত্রীর চোখ-কান খোলা নেই , 

কোথাও সে ছোটে না ,

ইচ্ছেমত হাঁটে না ,

সাত চড়ে রা-কাটে না , 

সেই মেয়ে জ্যান্ত … গোটা চার আনত । ( মুমিন গনের চারবিবাহ ইসলাম সম্মত তাই !)

ব্যতিক্রম কিছু নিশ্চয় আছে । এইসব শিক্ষিত ‘মডারেট’ মুসলিম ‘ব্যতীক্রমী’রা, উদারমনা মেয়েদের চক্ষুলজ্জা ও সামাজিকতার খাতিরে ফেলতেও পারে না , গিলতেও পারে না । তাই একটা সেফ দুরত্ব বজায় রেখে উপর উপর বাহ বাহ , প্রশংসা করে । কিন্তু জীবন সঙ্গী বানানোর ক্ষেত্রে ঢোক গিলে ক্ষমা চায় ।

এদিকে শিক্ষাব্যবস্থার সাথে যুক্ত প্রত্যেকেই জানে বছর বছর সমীক্ষাগুলোও বলছে এখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই সিরিয়াসলি পড়াশুনাটা করছে । খানিকটা স্বভাবগত বাধ্য সন্তান হওয়ার কারণে , আর খানিকটা বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজের পরিচিতি খোঁজার তাগিদে । রেজাল্ট মাধ্যমিক হোক বা উচ্চমাধ্যমিক পাতা খুললেই ডেটা হাজির । অস্বীকার করার উপায় নেই ।

Marriageকিন্তু বিয়ের জন্য এইসব উচ্চ শিক্ষিত মেয়েদের জুরিদার পেতে ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’ দশা ।

এখন অনেকেই বলতে পারেন , এত প্যাঁচাল পেড়ে লাভ কি ! বিয়ে না করলে কি মেয়েদের চলে না ? আজীবন অবিবাহিত থেকে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানকে কাঁচকলা দেখাও , ল্যাঠা চুকে যায় ।

নিশ্চয় যায় , আলবাত চুকে যায় ।

কিন্তু কথা হল , তাহলে কি ধরে নেওয়া হবে, যেহেতু তুমি আত্মসম্মানী মেয়ে এবং উচ্চশিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত চোখ কান খোলা সুতরাং তোমার জন্য বিয়ে-সংসার নিষিদ্ধ । এতে শিক্ষিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গর্বের শতকরা হার কি বেড়ে যাবে ?

দেখুন, একটা সরল উদাহরণ দিই । একটা পথ কঠিন , কাঁটা বিছানো বলে সেটাকে এড়িয়ে চলে যাওয়া তো সবচেয়ে সোজা কাজ । সবচেয়ে সরল পথ । এর মধ্যে মহত্ত্ব নেই । বরং সেই কাঁটা পথকে নির্মল করে সবার জন্য যাতায়াতের উন্মুক্ত ব্যবস্থা করাটাই উন্নতির পরিচায়ক ।

সব শিক্ষিত নারীই যে অবিবাহিত হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এমন তো কোনো মানে নেই । ছেলেরাও যেমন একটা সুন্দর সুস্থ বিবাহিত জীবনের বাসনা রেখে স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিক সেই একই কথা কি মেয়েদের বেলায় খাটে না ?

নাকি , মেয়ে বলেই তার জন্য সর্বদা আলাদা নিয়ম হবে ? যদি নিয়ম না মেনে স্বাধীনচেতা হয় তবে সুস্থ সুন্দর সমাজ তার আশাতীত হবে ? তার জন্য রুদ্ধ হবে সব স্বাভাবিক দ্বার ?

এটা কি কোনো উন্নত দেশের একটা জাতির সামাজিক মানচিত্র হতে পারে ?

শেয়ার করুন:

সমস্যাটা ওখানেই, ছেলেদের লেখাপড়ার হার খুবই কম।, কেন কম? মূলত তারা যে পরিবারে জন্মেছে সেখানে কোনো রোজগার নেই, একটু বড়ো হলেই কাজে জুড়ে দেয়। দেশে শিল্প নেই, কাজ নেই, তাই এই অবস্থা।মেয়েদের কাজের স্কোপ বাড়ালে এটা থাকবে না। স্টেটের এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা উচিত।

মেয়েদের বাধা পদেপদে। কিছু উপেক্ষা করতে হবে।কিছু ত্যাগ করতে হবে। এখনো অনেক পথ বাকি। পড়াশোনা করলে বিধবা হয়ে যেতে হয়। এই ধারনা পেরতে পেরেছি যখন এটাও পারব